Advertisement
E-Paper

এতই ভয় প্রতিবাদকে?

২০১৮-র ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসার ঘটনায় বেশ কয়েক জন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সমাজকর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছিল পুলিশ। এফআইআরে গোয়া ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডের নামও ছিল। সেই এফআইআর খারিজ করার জন্য তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৮
প্রশ্নকারী: দলিত সমাজকর্মী আনন্দ তেলতুম্বডে (ফাইল হাতে) সাময়িক নিষ্কৃতি পাচ্ছেন পুলিশ হেফাজত থেকে, ২ ফেব্রুয়ারি, পুণে। পিটিআই

প্রশ্নকারী: দলিত সমাজকর্মী আনন্দ তেলতুম্বডে (ফাইল হাতে) সাময়িক নিষ্কৃতি পাচ্ছেন পুলিশ হেফাজত থেকে, ২ ফেব্রুয়ারি, পুণে। পিটিআই

মেয়াদ আর কত দিনের?— না, এ পোড়া দেশে প্রকৃত স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের মেয়াদ কত দিনের, সেই গভীর প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছি না। আপাতত জানার ছিল, দলিত শিক্ষাবিদ আনন্দ তেলতুম্বডের ‘মুক্ত’ থাকার মেয়াদ আর কত দিনের? যে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে মুম্বই বিমানবন্দর থেকে ২ ফেব্রুয়ারি সকালে তাঁকে গ্রেফতার করা হল, তাতে প্রায় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করার চেষ্টা হল যে, আনন্দ তেলতুম্বডে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক এক ব্যক্তি! তাঁকে এ ভাবে বাইরের ‘শান্তিপ্রিয় পৃথিবী’-তে ঘুরতেই দেওয়া যায় না! বিশেষত তাঁরই অন্য ‘সহযোগী’দের যখন জেলে পোরা গিয়েছে!

২০১৮-র ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসার ঘটনায় বেশ কয়েক জন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সমাজকর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছিল পুলিশ। এফআইআরে গোয়া ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডের নামও ছিল। সেই এফআইআর খারিজ করার জন্য তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। শীর্ষ আদালত সেই আবেদন খারিজ করে। তবে আগাম জামিনের আবেদন পেশের জন্য তাঁকে চার সপ্তাহ সময় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না।

কিন্তু হেলায় সেই নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে পুণে পুলিশ যে ভাবে আনন্দ তেলতুম্বডেকে কোচি থেকে মুম্বইয়ে নামা মাত্রই গ্রেফতার করে তাতে সরকারি মনোভাবটা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন নয় যে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশের কথা জানত না। পুলিশ এও খুব ভাল করেই জানে, তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ। আদতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আনন্দ অামদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের প্রাক্তনীও। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন।

অবশ্য এই আগ্রাসী রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে যে প্রশাসন কাজ করে, যে প্রশাসন স্রেফ রাজনৈতিক প্রভুদের আজ্ঞাবাহী, তার কাছে বিনায়ক সেন, ভারাভারা রাও, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সোমা সেন, সুধীর ধাওয়ালে, মহেশ রাউত বা আনন্দ তেলতুম্বডের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী, ব্যাঙ্ক ডাকাত, লুটেরা বা ধর্ষকের কোনও ফারাক আছে বলে মনে হয় কি? মনে কি হয় যে, এ দেশে মুক্তচিন্তার পরিসর আছে?

আনন্দ তেলতুম্বডেকে গ্রেফতার করার সময়ে তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারে না। এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ। এমনকি, তাঁকে তাঁর পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতেও দেয়নি পুলিশ। এতে অাশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ, আনন্দের গোয়ার বাড়িতে তাঁদের অনুপস্থিতিতে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে তল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ।

আদালতের হস্তক্ষেপে তেলতুম্বডে এ যাত্রায় ছাড়া পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর খারিজ করার যে আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি, আদালত তা খারিজ করেনি। ওই এফআইআরে পুলিশ গুরুতর অভিযোগ এনেছে আনন্দদের বিরুদ্ধে। আরও ১৪ জন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সামাজিক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেও এই একই অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথমত, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দ্বিতীয়ত, ভীমা-কোরেগাঁওতে ২০১৮-র ১ জানুয়ারি দলিত সমাবেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, তাতে প্ররোচনা দিয়েছিলেন এঁরাই। পরে পুলিশ দাবি করে, অভিযুক্তেরা সকলেই ‘আর্বান নকশাল’।

ওই এফআইআর যাতে নাকচ করা হয় তার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তেলতুম্বডে। গত ২১ ডিসেম্বর বম্বে হাইকোর্ট তাঁর আর্জি খারিজ করে দেয়। তবে, তিন সপ্তাহ তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না বলে কোর্ট রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান। সেখানেও এফআইআর বাতিল করার আর্জি খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, তাঁকে চার সপ্তাহ গ্রেফতার করা যাবে না। তবে এই সময়ের মধ্যে তিনি নিম্ন আদালতে জামিনের জন্য আবেদন জানাতে পারেন। ইতিমধ্যে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশে ভীমা-কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় ধৃতদের জামিন পাওয়াটাই কঠিন হয়ে উঠেছে। জামিন সংক্রান্ত একটি মামলায় বম্বে হাইকোর্ট বলেছিল যে অভিযুক্তরা জামিন পেতে পারেন। এর বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেলে ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের রায় খারিজ করে দেয়, কারণ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইউপিএ ধারা প্রযুক্ত হয়েছিল।

প্রসঙ্গত তেলতুম্বডের আইনজীবী কপিল সিব্বলের বক্তব্য হল— এই দলিত শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে পুলিশ এখনও কোনও তথ্যপ্রমাণই পায়নি। বিচারপ্রক্রিয়া কোন পথে, কী ভাবে চলবে তা আদালত ঠিক করবে। কিন্তু তার আগেই যে ভাবে এই সমাজকর্মীদের উপর অত্যন্ত গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হল, যে ভাবে একাধিক জায়গার পুলিশকে দিয়ে অভিযান চালানো হল, তার পিছনে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট বলে সিব্বলদের যুক্তি।

এ সব দেখেশুনে একটা কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও প্রতিবাদী স্বরকেই প্রবল হতে দেওয়া যায় না। এই মুহূর্তে ‘হীরক রাজার দেশে’ হাওয়া বিশেষ ভাল নয়। হাওয়া যেন কেমন উল্টোপাল্টা। তাই রাজাকে আপাতত এমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে এই কয়েক মাসে কেউ আর উল্টো কথা বলে তাঁকে বিপদে ফেলার সাহস না পায়! দশকের পর দশক ধরে সমাজের নানা অনিয়ম নিয়ে যাঁরা সরব হয়েছেন, শাসকের চোখে চোখ রেখে নানা অপ্রিয় প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের ঘাড় ধরে অন্ধকূপে পাঠিয়ে দিয়ে হাস্যমুখে রাজা শুধু জয়ধ্বনি শুনতে চান। ধরে নিতে পারি কি যে, রাজা ভয় পাচ্ছেন?

ঠিক এমন ভাবেই ভয় পেয়েছিলেন অজাতশত্রু, মগধ রাজ্যের এক কোণে নিভৃত উপবাসে থাকা নটীকে দেখে। আমরা এক নাট্যে দেখেছি, নটী শ্রীমতী রাজা অজাতশত্রুকে বলছেন, ‘‘...আসলে রাজা উদাসীন থাকে, যাতে মানুষ জয় কালীকরালীর নামে হানাহানি চালাতে পারে। ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষ যখন খেপে ওঠে, তখন রাজা কী ভাবে আনবেন স্থিরতা? তাই তাঁকে বুদ্ধি করে যুদ্ধ করে সব কিছু বিশৃঙ্খল রেখে দিতে হয়।’’ আর অজাতশত্রু বলছেন, ‘‘...তোমার ওই নিভৃত উপবাসকে আমি ভয় পাই।’’ শাসকের ধর্ম মেনে অজাতশত্রুর উপলব্ধি: ‘‘ওকে বাঁচিয়ে রাখো। ওকে মারলে ও অমর হয়ে যাবে। ওকে ফেলে রাখো এক কোণে। দেখবে, মানুষ আস্তে আস্তে ওকে ভুলে যাবে।’’

শাসকের ভাষা তবে যুগে যুগে ঠিক এ ভাবেই ‘ক্লোন’ করা যায়!

Anand Teltumbde Pune Supreme Court of India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy