Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মেয়েরা মায়ের জাত, এতেই কি আটকে যাবে কেরিয়ার

মামণি হয়ে রয়েছি কেন!

কর্পোরেট জগতে থেকেও মায়ের দায়িত্ব পালন করার নজির রয়েছে। যেমন, ইন্দ্রা নুয়ি, ধাপে ধাপে কর্পোরেট জগতের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন; তাঁর শিশুকন্যাটি যাতে নিজেকে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন মনে না করে, সে জন্য উনি অফিসের টেলিফোন অপারেটরকে বলে রেখেছিলেন মা হয়ে কথা বলতে।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

মা যখন অপিসে যায়, এমনই কান্না পায়’ এই রকম একটা লাইন, সঙ্গে ছলছল গভীর চোখের একটি শিশুর মুখ। প্রায় বছর কুড়ি আগে এটা ছিল একটি জনপ্রিয় তেলের বিজয়াদশমীর বিশেষ বিজ্ঞাপন। ‘অফিসযাত্রী’ মা আর তাঁর সন্তানের মধ্যেকার অনুচ্চারিত টানাপড়েনকে এখন আর এত সরাসরি তুলে ধরা হয় না। কিন্তু কর্মরতা মহিলা ও তাঁর মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয়গুলো কি তাই বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে? মোটেই না বরং একটা প্রশ্ন ভেঙে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের নারীদের সাপেক্ষে সে সব প্রশ্নের উত্তর অনেকটা আলাদা।

কর্মরতা মহিলা গোষ্ঠীর এক প্রান্তে আছেন নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বল্পশিক্ষিত মেয়েরা, চাষের কাজে, মাটি কাটায়, রাজমিস্ত্রির কাজে লেগে থাকা মহিলা শ্রমিকরা। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে কাজের জায়গাটা কাছাকাছি হলে বা যাতায়াতটা সুবিধেজনক হলে অর্থাৎ বাচ্চাকে ছেড়ে খুব বেশি ক্ষণ থাকতে না হলে এই মেয়েরা কাজে পিছিয়ে থাকেন না। শহরের দিকে এই রকম মহিলারা অনেকে দূরে গিয়ে বাঁধা মজুরির কাজের বদলে কম মাইনে হলেও বাড়ির কাছাকাছি পরিচারিকার কাজ, সেলাইয়ের কাজ বা এই ধরনের কোনও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ বেছে নেন যাতে সংসারের দেখাশোনাটাও চালানো যায়। অর্থাৎ সংসার ও বাচ্চাকে দেখাশোনা করার দায়িত্বটা এই বৃত্তের মেয়েদের কাজ করা না-করার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার।

আবার কর্পোরেট জগতে থেকেও মায়ের দায়িত্ব পালন করার নজির রয়েছে। যেমন, ইন্দ্রা নুয়ি, ধাপে ধাপে কর্পোরেট জগতের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন; তাঁর শিশুকন্যাটি যাতে নিজেকে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন মনে না করে, সে জন্য উনি অফিসের টেলিফোন অপারেটরকে বলে রেখেছিলেন মা হয়ে কথা বলতে। বাচ্চাটি ফোন করলে টেলিফোন অপারেটরই ‘মা’ হয়ে বাচ্চার ইস্কুল-টিফিন-হোমওয়ার্কের খবর নিতেন। কেরিয়ারের উঁচু থেকে আরও উঁচু ধাপে উঠতে উঠতেও এক জন মহিলা যে জীবনের এই দিকটা উপেক্ষা করতে পারেন না এটা তার উদাহরণ। উল্টো দিকে আছেন সুপ্রিয়া রাজ জোশী; ইস্কুলে মেয়েদের কিছু সমস্যা হচ্ছিল বলে যিনি নিজের চাকরি ছেড়ে মেয়েদের পড়াশোনা নিজের হাতে নিয়েছেন, হোম স্কুলিং-এ অভ্যস্ত করেছেন। বাড়িতে পড়াশোনা করেই বড় মেয়ে এমআইটি’তে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। সুপ্রিয়া কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন। মায়েরা সবাই হয়তো চাকরি ছেড়ে দেন না কিন্তু কেরিয়ারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া, স্নাতকোত্তরের পর গবেষণা করতে না পারা, পিএইচ ডি করেও স্কুল-কলেজে পড়ানো অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম চ্যালেঞ্জিং পেশায় ঢুকে যাওয়া, ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হয়েও যথেষ্ট কাজ করতে না পারা ইত্যাদি মেয়েদের মধ্যে খুবই নিত্যকার ব্যাপার। যে কারণে মেয়েদের উচ্চশিক্ষাকে অনেকেই ‘লিকিং পাইপ’-এর সঙ্গে তুলনা করেন। অর্থাৎ বিষয়টা যখন সন্তানের শিক্ষা, তখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নির্বিশেষে মেয়েদের অবস্থান মোটামুটি একই থেকে যায়। নুয়ির মতো যাঁরা উপযুক্ত ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ তৈরি করতে পারেন তাঁরা টিকে থাকেন, যাঁরা পারেন না তাঁরা পিছিয়ে পড়েন সুপ্রিয়া জোশীর মতো।।

কিন্তু সুপ্রিয়া জোশীরা তো এটাকে পিছিয়ে পড়া বলে মনে করছেন না বরং সন্তানের সাফল্যকেই নিজের সাফল্য বলে মনে করছেন আর প্রভূত বাহবাও পাচ্ছেন। সন্তানের দায়িত্ব মেনে নিয়ে সহায়ক ব্যবস্থাটা যতটা সম্ভব অনুকূল করে তোলাই যে উপযুক্ত সমাধান ইন্দ্রা নুয়িও সে কথা পরিষ্কার করেই বলেছেন। তা হলে এক বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে গিয়ে পরিবর্তন কিছু হল না! যাতায়াত-বাচ্চা রাখার ব্যবস্থার উন্নতি করে খেতের কাজে-ইটভাটায়-মাটি কাটায় মহিলা শ্রমিকদের যোগ দেওয়ার হার যদি বা বাড়ানো যায়, কিন্তু যে মহিলারা— বিজ্ঞানী, পুলিশ, গোয়েন্দা বা সাংবাদিক— নিজের রক্ত জল করে তৈরি কেরিয়ার প্রায় স্বেচ্ছায় ছেড়ে ‘কম চাপ’-এর (এবং কম উন্নতির) পেশা বেছে নিয়েছেন তাঁদের উপযুক্ত কাজে ফেরা বা ফেরানোর গল্প সহজ নয়।

এখানে এসে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কেরিয়ারের ‘গ্লাস সিলিং’ ভেঙে শিখরে পৌঁছেছেন যে মহিলা, তিনিও যখন এই কথাই বলেন তখন আমাদের নতুন সংশয়ের জন্ম হয়। নিজেদেরই কাটাছেঁড়া করে জানতে ইচ্ছে করে সন্তানের দায়িত্ব বিষয়ে মেয়েরা কেন এতটা সমঝোতা করে! এটা নিঃসন্দেহে এক সামাজিক নির্মাণ কিন্তু এর জন্য দায়ী করব কাকে? মাতৃত্বকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ তা এক বিকল্পহীন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। আর পিতৃতন্ত্রের জোয়ালের বিরুদ্ধে মেয়েরা অন্যত্র তো কম লড়াই করে না, তা হলে এখানে এসে ঝকঝকে কেরিয়ারের মেয়েটা কেন বাচ্চার পড়াশোনার কথা ভেবে দূরের শহরের চাকরি ছেড়ে দেয়, কেন প্রবাসী মেয়েটা বছরে এক বার দু’সপ্তাহের জন্য দেশে আসাটাও স্থগিত রাখে মেয়ের পরীক্ষার জন্য!

এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কারণ পিতৃতন্ত্রের অনুশাসনই একমাত্র বিষয় হলে ভারতের উত্তর-পূর্বের কিছু জায়গায় সমাজ যেখানে মাতৃতান্ত্রিক, সেখানে মেয়েদের গল্পটা অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেখানেও অধিকারের পাশাপাশি সন্তানের প্রতিপালনের সব দায়িত্বই মায়ের ওপর এসে পড়ে। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি এই যে বিকল্পহীন দায়বদ্ধতা, সব রকম কাঠামোয় মায়েদের রাস্তা এখানে এসে মিলে যায় একই বিন্দুতে। আমরা তাই পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনের বাইরেও একটা নিরপেক্ষ কারণ খোঁজার চেষ্টা করি, যেটা মেয়েদেরই তৈরি সমস্যা, যার সমাধান হওয়া বা না-হওয়াটাও অন্তত আমাদের হাতে আছে।

ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষ মূলত সন্তানের জন্য বাঁচে। এখানে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে স্বামী-স্ত্রী অনেক সময় আলাদা হয়ে যান সন্তানের পড়াশোনার সুষ্ঠু ব্যবস্থার জন্য। কারণ সন্তান তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন, সম্পদ, ভবিষ্যৎ এবং বিনিয়োগ, তাকে যত দূর সম্ভব শ্রেষ্ঠ পরিকাঠামো দেওয়াই মা-বাবার লক্ষ্য। আমাদের নিরাপত্তাহীন সমাজে সেই ভাবনা খুব অন্যায়ও বলা চলে না। এখানে কর্তব্যনিষ্ঠ উজ্জ্বল সন্তানকে বাবা-মায়ের সাফল্য হিসেবেই দেখা হয়। বাবা-মায়েরা মুখে যা-ই বলুন, মনে মনে চান সন্তান যেন তাঁদের চেয়েও প্রতিষ্ঠিত হয়। উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত বাবা-মা’র সন্তান যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত না হলে সে বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে। ঠিক এই কারণেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পড়াশোনা, বেড়ে ওঠাটার সঙ্গে বিশেষত শিক্ষিত মায়েরা সমঝোতা করতে চান না। আজ নিজের কেরিয়ারের জন্য যে মা সন্তানের দিকে যথেষ্ট নজর দিতে পারছেন না, পনেরো বছর পরে তাঁর সন্তান যদি আর পাঁচ জন ‘কেরিয়ারবিহীন’ মায়ের সন্তানদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে, তা হলে সে বড় আফসোসের। শুধু এই ভেবেই অনেক মায়েরা নিজের স্বপ্ন-উচ্চাশা কাটছাঁট করে সন্তানের টিফিনবক্স আর হোমওয়ার্কের খাতায় ঢুকিয়ে দেন। এই আত্মত্যাগ আসলে এক ধরনের বিনিয়োগ, সন্তানের সাফল্যই যার একমাত্র ‘রিটার্ন’।

প্রশ্ন হল, মায়ের অখণ্ড মনোযোগ সত্যিই সন্তানের একান্ত প্রয়োজন কি না, যার জন্য ত্যাগসাধনটা মা’কেই করতে হবে। এটাই প্রয়োজন না কি এই সেই সামাজিক নির্মাণ, যা আসলে নারীকে নিজের শিকলেই বেঁধে রাখে। এ প্রশ্নের উত্তরও বড় কঠিন কারণ শিশুর নানা রকম অসুবিধের সমাধান হিসেবে মনস্তাত্ত্বিকরা মায়েদের পরামর্শ দেন সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে। আর একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মায়ের সঙ্গে সন্তানের ‘বায়োলজিক্যাল কানেকশন’-এর মাহাত্ম্য। হয়তো কিছুটা সেই মাহাত্ম্যেই (কিংবা সন্তানকে বংশপরিচয় দিতে পারেন না বলেও) মা-ও সন্তানের মধ্যে নিজের সবটুকু ভালকে দেখতে চাওয়ার আশাটা ছাড়তে পারেন না। সুতরাং সন্তানকে ‘মনের মতো গড়ে’ তোলার বাসনা যে মায়েদের নিজেদের মনের মতো জায়গা থেকে সরে আসতে কিছুটা হলেও ইন্ধন জোগায়, এটা মানতেই হয়।

সমাজও সেটাই চায়, উল্টোটা হলে সেটা মায়ের স্বার্থপরতা হিসেবে দেখা হয়। সামাজিক নির্মাণের সবচেয়ে কঠিন অংশ এইটুকুই, যেটা শুধু প্রতিবাদ দিয়ে ভাঙা যায় না। তাই আমাদের মায়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ে, চাইল্ড কেয়ার লিভ চালু হয়। মেয়েরাই তাতে খুশি হন। অথচ ‘পিতৃত্বকালীন ছুটি’র ব্যাপারটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয় না। সদ্য পাওয়া পিতৃত্বের দায়িত্ব ঠিকঠাক নিতে হলে বা সন্তান পালনের দায়িত্বে ছেলেদের আরও বেশি করে অংশ নিতে হলে, এই ছুটির যে কোনও বিকল্প নেই, তা মেয়েরাও যেন বুঝতে চান না। এটাও একটা সামাজিক নির্মাণ।

এই লেখার শেষে তাই কোনও স্পষ্ট সমাধানে পৌঁছোনো যাচ্ছে না, একটি অপরাধীকে নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। মায়ের কেরিয়ার-শখ-আহ্লাদ সমস্ত অধিকারের দাবি নিয়ে সচেতন ও সরব হয়েও এক জন মহিলা শেষমেশ কেন ঠিকঠাক মামণি হয়ে উঠতে চেয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে ফেলেন, এখানে শুধু তার কারণ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কোনও চিত্রই সম্পূর্ণ নয়, শুধু খণ্ড খণ্ড আয়নায় নিজের মুখের ছবি খুঁজে বেড়ানো, সেটাই উত্তর।

শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Motherhood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE