Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ব্যাকরণের ভুল

এয়ার চিফ মার্শাল বি এস ধানোয়া-র কথাটি সত্য, না কি তাহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই প্রশ্ন উঠিতেছে। এই ভাবে প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করিয়া ফেলা মস্ত ভুল। প্রশাসনের ব্যাকরণের ভুল।

রাফাল নিয়ে অস্বস্তি বাড়ল।—ফাইল চিত্র।

রাফাল নিয়ে অস্বস্তি বাড়ল।—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পাণিনি নহেন। নোম চমস্কিও নহেন। ব্যাকরণের প্রশ্নে আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার শিরোধার্য। রাফাল চুক্তি মামলায় শীর্ষ আদালতের নিকট মুখবন্ধ খামে যে তথ্য পেশ করিয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকার, আদালত তাহার ব্যাখ্যা করিতে ভুল করিয়াছে বলিয়াই সরকারের আবেদন। ক্রিয়াপদের কোনটি নিত্য অতীত আর কোনটি পুরাঘটিত বর্তমান, সেই তর্কটি বৈয়াকরণ বা ছিদ্রান্বেষীদের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া যাইত। যাইতেছে না, কারণ ক্রিয়াপদের সেই রূপের উপর দাঁড়াইয়া আছে একটি জটিল বিবেচ্য— কেন্দ্রীয় সরকার কি আদালতে অনৃতভাষণ করিল? করিলে, তাহাকে পুরাঘটিত অতীত হিসাবে দেখা হইবে, না কি ঘটমান বর্তমান? প্রশ্ন হইল, রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত তথ্য সিএজি-র নিকট পেশ করা হইয়াছে, এবং পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স কমিটি তাহা পরীক্ষা করে, বাক্যটিকে এমন ধোঁয়াশাময় করা হইল ব্যাকরণের কোন সত্যরক্ষার্থে? রাফাল চুক্তির তথ্য পিএসি-র সম্মুখে পেশ করা হয় নাই, এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলিতে বাঁধিল কেন? পিএসি-র প্রধান পদটিতে আছেন কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খার্গে। রাফাল চুক্তির বিস্তারিত তথ্য বিরোধীরা জানিয়া ফেলিবেন, সেই আশঙ্কাতেই কি? অথবা, পিএসি এই তথ্য দেখে নাই শুনিলে সুপ্রিম কোর্টও চুক্তিটিকে ছাড়পত্র দিতে আপত্তি করিত, কেন্দ্রীয় সরকারের মনে তেমন ভয় ছিল?

অস্পষ্টতা শুধু কোর্টের নিকট পেশ করা তথ্যেই নহে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাফাল চুক্তির আগাগোড়াই অস্বচ্ছ। যেমন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের চুক্তি করিতে কেন প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্সযাত্রার প্রয়োজন হইল? স্বাভাবিক ভাবে, সেই দায়িত্ব প্রতিরক্ষামন্ত্রীর, প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রীরও বটে। সেই সময় ফ্রান্সে অনিল অম্বানীর উপস্থিতিও নেহাত সমাপতন কি না, প্রশ্ন উঠিয়াছে। কেন একটি ভুঁইফোঁড় সংস্থা হিন্দুস্থান অ্যারোনটিকস লিমিটেড-কে টপকাইয়া দাসো-র ভারতীয় সহযোগী হইয়া উঠিল, সেই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর মিলে নাই। বহু কথা চালাচালি হইয়াছে, বিরোধীদের অভিযোগের প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী বফর্স চুক্তির প্রসঙ্গটিকে ধুলা ঝাড়িয়া ফের রাজনীতির মঞ্চে সাজাইয়াছেন। কিন্তু, রাফাল চুক্তি প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দেন নাই। কত দামে বিমান কেনা হইতেছে, সেই তথ্য জনসমক্ষে আসিলে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইবে কেন, তাহাও জানা যায় নাই। যে চুক্তির আগাগোড়া এত গোপনীয়তা, এত নীরবতা, সেই মামলাতেই আদালতে জমা করা হলফনামায় যদি বিভ্রান্তির উপাদান থাকে, সন্দেহ হইবে না যে তাহা অহেতুক নহে?

এই গোপনীয়তা কেন? রাফাল চুক্তি যদি দেশের প্রতিরক্ষার স্বার্থে অতি জরুরিও হয়, তাহাকে বিরোধীদের ধরাছোঁয়ার বাহিরে রাখিবার যৌক্তিকতা কী? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকরা যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিরোধী দলের সাংসদরাও ঠিক তাহাই। শাসকরা যেমন দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, বিরোধী দলগুলিও তাহাই করে। দেশের স্বার্থে যাহা ঘটিতেছে, তাহা যেন জনপ্রতিনিধিদের শুধুমাত্র এক অংশের জানা না থাকে, তাহা নিশ্চিত করা সরকার পক্ষের কর্তব্য। পিএসি নামক কমিটির শীর্ষে বিরোধী দলনেতাকে রাখিবার নীতির যৌক্তিকতা সেখানেও। রাফাল চুক্তিকে কেন্দ্র করিয়া এই গোপনীয়তায় সর্বাপেক্ষা ক্ষতি হইতেছে সরকারেরই। বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকিয়াছে। বস্তুত, শুধু সরকার নহে, সেনাবাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের সম্মুখীন। এয়ার চিফ মার্শাল বি এস ধানোয়া-র কথাটি সত্য, না কি তাহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই প্রশ্ন উঠিতেছে। এই ভাবে প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করিয়া ফেলা মস্ত ভুল। প্রশাসনের ব্যাকরণের ভুল। তাহা বুঝিতে পাণিনি বা চমস্কি হওয়ার প্রয়োজন নাই। সদিচ্ছা থাকিলেই যথেষ্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rafale Government Rafale Deal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE