Advertisement
E-Paper

সম্প্রীতির চারণভূমিতে আচমকা এত আতঙ্কের পরিবেশ কেন?

বর্তমান অস্থির অবস্থায় মানুষ কি কেবলই রাজনীতিকদের দাবার ঘুঁটি? শিক্ষিত বিবেকের এত অভাব কেন চার দিকে? লিখছেন রুদ্র সান্যাল

রুদ্র সান্যাল

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৩

সুদূর অতীত কাল থেকেই আমাদের বাংলা দেশ বা বঙ্গদেশে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠী শাসন করে গিয়েছে। স্থানীয় জনগণ নিজেরাই সেই শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। একই সঙ্গে শাসকও তাঁর অধীন জনগোষ্ঠীকে নিজের আপন ভেবেই কাজ করে গিয়েছে।

সুদীর্ঘ কাল এই ভাবেই চলেছে। বৌদ্ধ আমলেও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিহার তৈরি হয়েছে। শিক্ষাদান হয়েছে। প্রাচীন বঙ্গদেশ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের ঠিক আগে পর্যন্ত যে সব শাসকেরা এই দেশ শাসন করে গিয়েছেন, তাঁরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন সচেতন ভাবেই। চৈতন্যের বাংলায় সেই সম্প্রীতি এখনও লোকমুখে খুঁজে পাওয়া যায়। বৈষ্ণব সাহিত্যেও সেই ছবি লক্ষ করা যায়।

যদিও হিন্দু বাঙালির মধ্যে কৌলিন্য প্রথার সংস্কার করেন বল্লাল সেন। তবুও বাংলায় ইসলামি শাসন প্রবর্তনের সময়ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি ছিল না। বাংলার ইসলামি শাসনের স্বর্ণযুগ ছিল হুসেন শাহের আমল। সেই আমলে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো। চৈতন্য এবং তাঁর অনুগামীদেরকে ভক্তিপ্রচারে হুসেন শাহ সহায়তা করেন। তাঁর প্রশাসনে উচ্চ পর্যায়ের হিন্দু কর্মকর্তা ছিলেন রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি ধীরে ধীরে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিষবাষ্পের সৃষ্টি করে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর যে পরিমাণ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হয়, তাতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অঞ্চলেই উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্র জনবিস্ফোরণ হয়। তবুও এপার বাংলার মানুষ ওপার বাংলার শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষদেরকে ধীরে ধীরে আপন করে নেন। শত যন্ত্রণার মধ্যেও ক্ষোভ-দুঃখ নিয়ে ভিটেমাটি হারানো মানুষেরাও এখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশে যান।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এই বহুচর্চিত বিষয়গুলি এখন আবার লিখতে বসা কেন? আসলে এক বিশাল ভয় বা আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মনে। এই রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলায় সম্প্রীতির যে পরিবেশ এবং তা বজায় রাখার যে স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল, তা কেমন যেন এখন ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে। শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিক্রিত বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। চতুর্দিকে যা চলছে, তা দেখে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটুকু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ এই কথাটাও আজ সত্যিই কেমন যেন ফিকে ফিকে লাগছে।

বর্তমান এই ঝরা সময়ের মাঝে এই কথাটাই বারবার মনের ভিতর নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, এর জন্য কারা দায়ী? সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে। তবে যদি অশান্ত এই সময়ে শান্তি ফিরে আসে। ভোটের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে রাজনীতি চলেছে, সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কিন্তু তার জন্য ফল ভুগতে হচ্ছে সব মানুষকে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের এই সম্প্রীতির চারণক্ষেত্র বাংলাতেই এখন অশান্তি আছড়ে পড়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা। হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে হানাহানির মধ্যে।

সাধারণ মানুষের ক্ষোভ স্বাভাবিক। কিন্তু লাগাম হারাচ্ছে। আজ কেউ বাস ভাঙছে, কাল কেউ ট্রেন ভাঙছে। ঢিল ছোড়া হচ্ছে ট্রেনের জানালায়। কারা আহত হচ্ছেন? সে খোঁজ কে রাখেন? কেউ বা ওই বিক্ষোভকারীদের সে কথা বোঝান? যে পরিমাণ হিংস্রতা ক্ষোভ প্রত্যেকের মনের মধ্যে উস্কে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে সভ্যতার অর্থটাই বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত।

আমরা আধুনিক হচ্ছি বলে দাবি করি। সত্যিই কি তাই? ক্রমশ বন্য হিংস্র জন্তু হয়ে যাচ্ছি না তো? কেউ গরুর মাংস খেলে তাঁকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করি না। ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপে না। যে ভাবে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে ক্ষতি কার হচ্ছে? রাজনীতি সর্বস্ব নেতাদের কাছে সাধারণ মানুষ কি কেবলই দাবার ঘঁুটি?

কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। সে তো এখন আর কথার কথা নয়, দেশের প্রতিচ্ছবি যেন। চারিদিকে শুধু ভয়ের দেওয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষ ভাবে জরুরি। আবার একটা নবজাগরণের খুব দরকার আমাদের। ততদিন পর্যন্ত সম্প্রীতি তাই শুধুই খাতায়কলমে আর মহাপুরুষদের বাণীর মধ্যে আবদ্ধ

না থেকে আমাদের মনে, বিশ্বাসে, জেগে থাকুক।

(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

CAA CAB NRC Ballal Sen
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy