শুরু। বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ। কলকাতা, ২৩ অগস্ট ২০১৫। ছবি: এএফপি।
গ ত ২৩ অগস্ট একটা পুরোদস্তুর ব্যাঙ্ক হিসেবে যাত্রা শুরু করল বন্ধন। ঘটনাটা একাধিক কারণে উল্লেখের দাবি রাখে। ষোলো আনা বাঙালি একটা কোম্পানি ব্যাঙ্ক লাইসেন্স পাওয়ার দৌড়ে রথী-মহারথীদের পিছনে ফেলে পুরস্কার জিতে নিল, এটা বিরল ঘটনা। তার ওপর, এই প্রথম আমাদের দেশে একটা মাইক্রোফাইনান্স ইন্সটিটিউশন বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ব্যাঙ্কের মর্যাদা পেল, এটাও লক্ষণীয়। কিন্তু সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল, যে-অনুৎপাদক সম্পদের ভারে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর ইদানীং নাভিশ্বাস উঠেছে, বন্ধন ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থায় সেই অনুৎপাদক সম্পদ নেই বললেই চলে। প্রশ্ন উঠছে, অনুৎপাদক সম্পদ কমানোর ব্যাপারে বন্ধন কি তা হলে সাবেকি ব্যাঙ্কগুলোকে রাস্তা দেখাতে পারবে?
যে-টাকা ধার দিয়ে ব্যাঙ্কগুলো ফেরত পায়নি সেগুলোই তাদের অনুৎপাদক সম্পদ। গত ১৯ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী শেষ তিনটি কোয়ার্টার বা ত্রৈমালিক সময়পর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অনুৎপাদক সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৬.২, ৩.২ এবং ৮.৮ শতাংশ হারে। শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ৭.৫, ৬.৯ এবং ১০.৪ শতাংশ। কোনও কোনও হিসেব বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির গড় অনুৎপাদক সম্পদ তাদের মোট সম্পদের প্রায় ৬ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে। তুলনায় গত বছর বন্ধন তার ৯৯.৯ শতাংশ ঋণ ফেরত পেয়েছিল, অনুৎপাদক সম্পদের অনুপাত ছিল মাত্র ০.১ শতাংশ।
ব্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, অযোগ্যদের ধার দেওয়া এবং ধার দেওয়ার পর যথাসময়ে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য নিয়মিত তদারকির ব্যাপারে গাফিলতি করা— সাবেকি ব্যাঙ্কদের অনুৎপাদক সম্পদ বাড়ার পেছনে এই দুটোই মূল কারণ। এই দুটো ব্যাপারেই বন্ধন যোজন যোজন পথ এগিয়ে আছে। কেমন করে এই আশ্চর্যটা সম্ভব হল সেটা বোঝার জন্য বন্ধনের ধার দেওয়ার পদ্ধতিটা খতিয়ে দেখা দরকার।
বন্ধন ধার দেয় শুধু গরিব মহিলাদের। ধারের পরিমাণ এক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কোনও বন্ধকি ছাড়াই এই ধার দেওয়া হয়। গরিব মহিলাদের কাছে বন্ধক রাখার জন্য আছেটাই বা কী? বন্ধন ধার দেয় বেশ চড়া সুদে, তার ঋণের ওপর বার্ষিক সুদ ২২.৪ শতাংশ। এ ছাড়া উপায়ও নেই। সরকার অথবা অন্য কোনও জনহিতকারী সংস্থা থেকে এক পয়সাও ভর্তুকি পায় না বন্ধন। তা ছাড়া যে টাকা বন্ধন ঋণ হিসেবে গরিব মহিলাদের দিয়ে থাকে তা বাজার থেকে চলতি সুদে ধার করতে হয়। তার ওপর আছে প্রশাসনিক খরচ, এবং ঋণ-গ্রহীতাদের উপর সদাসতর্ক নজরে রাখার খরচ। সব মিলিয়ে ২২.৪ শতাংশ সুদের আয় থেকে ঋণপিছু সামান্যই লাভ হয়। কিন্তু যেহেতু মোট দেওয়া ঋণের পরিমাণ বিপুল, এখন প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকা, তাই বন্ধনের মোট লাভের অঙ্ক খুব কম নয়।
পঁচিশ-তিরিশ জনের এক-একটি দল তৈরি করে নিয়ে দলের সদস্যদের ধার দেয় বন্ধন। বন্ধনের থেকে ধার নেওয়ার জন্য এই রকম কোনও একটি দলের সদস্য হওয়া আবশ্যিক। দলের সদস্যদের ধার দেওয়া হলেও, ধার কিন্তু যৌথ ভাবে দলকে দেওয়া হয় না। এক এক জন সদস্য প্রয়োজন মতো এক এক অঙ্কের ঋণ পান, ঋণশোধের দায়িত্বও সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর নিজের। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থারা আগে দলগুলিকে যৌথ ভাবে ধার দিত, অর্থাৎ ঋণশোধের জন্য যৌথ ভাবে দায়ী থাকত পুরো দলটা। সেই ধাঁচ থেকে বন্ধন বেরিয়ে এসেছে।
কেন ধার দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে বন্ধন এতটাই সফল, তার কয়েকটা ব্যাখ্যা বন্ধনের ঋণ দেওয়ার পদ্ধতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রথমত, বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহিলারা পুরুষদের তুলনায় দায়িত্বশীল। বন্ধন-এর ঋণগ্রহীতারা যেহেতু সকলেই মহিলা, তাই তাঁদের ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। উপরন্তু বন্ধনের খাতকরা প্রায় সকলেই বিবাহিত মহিলা। অনেক ক্ষেত্রেই, স্ত্রীর বকলমে ধারটা আসলে নিচ্ছেন স্বামী। এর দুটো সুবিধে। এক, স্বামীর আয় থেকে ধার শোধ দেওয়াটা সম্ভব হচ্ছে এবং দুই, যেহেতু টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব স্ত্রীর, যাঁর দায়িত্বশীলতা কিংবা লোকলজ্জা পুরুষটির তুলনায় বেশি, তাই মহিলাটিই স্বামীকে তাগাদা দিয়ে টাকাটা শোধ করাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক সপ্তাহে দলের মিটিং হচ্ছে। বন্ধনের অফিসাররাই সে সব মিটিং পরিচালনা করছেন। সদস্যরা সেই মিটিং-এ সকলের সামনে তাঁদের সাপ্তাহিক কিস্তি শোধ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ধার শোধের ব্যাপারে তাঁরা পিছিয়ে নেই। দলের আর সবাই নিয়মিত ধার শোধ দেওয়ার ফলে প্রতিটি সদস্যের ওপর আলাদা করে ধার শোধ দেওয়ার একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তা ছাড়া কোনও সদস্য কয়েক সপ্তাহ মিটিং-এ না এলে বা ধারের কিস্তি শোধ করতে না পারলে বন্ধন-এর অফিসাররা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারছেন। তাঁরা তাঁর বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছেন, নিয়মিত তাগাদা করছেন, যতক্ষণ তিনি টাকা বাকি রাখছেন ততক্ষণ তাঁর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন।
এ ছাড়াও নিয়মিত ধারের টাকা ফেরত আসার কিছু বাড়তি কারণ আছে যা বন্ধন সম্পর্কে আমাদের একটা সাম্প্রতিক সমীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা দেখেছি, দলের সদস্যদের মধ্যে একটা সামজিক নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার ফলে তাঁরা যেমন আনন্দ-উৎসবের দিনে একে অপরের সঙ্গে থাকছেন তেমনই বিপদে-আপদে একে অপরকে সাহায্য করছেন। আমাদের উত্তরদাতাদের মধ্যে যাঁরা বলেছেন কোনও না কোনও সময়ে ঋণশোধ করতে তাঁদের অসুবিধে হয়েছে, তাঁদের ২৩.৮ শতাংশ জানিয়েছেন দলের অন্য কোনও সদস্য তাঁদের টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করতে সাহায্য করেছেন। আবার ৩৯ শতাংশ ঋণগ্রহীতা বলেছেন, দলের কেউ বিপদে পড়ে টাকা ফেরত না দিতে পারলে দলের মেয়েরা তাঁকে সাহায্য করে থাকেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, ঋণগ্রহীতাদের সামাজিক নেটওয়ার্ক থেকে সদস্যদের মধ্যে একটা পারস্পরিক অলিখিত বিমা তৈরি হচ্ছে যার ফলে সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধনও লাভবান হচ্ছে।
সামাজিক নেটওয়ার্ক-এর আর একটা সুবিধে আছে। এক দিকে যেমন দলের মেয়েরা দলের সুনাম বজায় রাখার জন্য নিজেদের সদস্যদের ওপর ঋণ শোধের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করছেন, তেমনই আবার নিজের সামাজিক সুনাম বজায় রাখার জন্য প্রতিটি সদস্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন প্রত্যেক সপ্তাহে কিস্তির টাকা শোধ করে দিতে। আমাদের সমীক্ষায় ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলছেন, কিস্তির টাকা শোধ না করলে দলের মেয়েরা ভয়ঙ্কর রকম রাগারাগি করবে। বন্ধন ও দলের যৌথ চাপ এতটাই যে এক জন উত্তরদাতা জানিয়েছেন, যে সপ্তাহে তাঁর স্বামী মারা গেলেন সেই সপ্তাহেও তাঁকে কিস্তির টাকা শোধ করতে হয়েছে। লক্ষণীয়, এত চাপ সত্ত্বেও কিন্তু লক্ষ লক্ষ গরিব মহিলা বন্ধন-এর কাছ থেকে ধার নিচ্ছেন। নিশ্চয় সুবিধে পাচ্ছেন বলেই নিচ্ছেন।
তা ছাড়া ছোট-ছোট সাপ্তাহিক কিস্তিতে টাকা শোধ দেওয়ার পদ্ধতি একটা আর্থিক শৃঙ্খলা স্থাপনের কাজ করে। ছোট ছোট কিস্তিতে টাকা শোধ দেওয়া, একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা ফেরত দেওয়ার চেয়ে ঢের সহজ। কয়েকটা ক্ষেত্রে এমনও দেখেছি, ঋণগ্রহীতা বন্ধনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে পুরো টাকাটাই ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট রেখে দিচ্ছেন। ২২.৪ শতাংশ সুদে টাকা ধার নিয়ে নয়-সাড়ে নয় শতাংশে জমা রাখার পেছনে কারণটা কী জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলাম, বন্ধন-এর থেকে টাকা ধার নেওয়াটা আসলে সঞ্চয়ের একটা উপায় মাত্র। গরিব পরিবারের পক্ষে প্রতি সপ্তাহে দুশো-আড়াইশো টাকা খরচ-খরচা থেকে সরিয়ে রেখে ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া শক্ত। টাকাটা ঠিক তালেগোলে খরচ হয়ে যায়। কিন্তু বন্ধন-এর কাছ থেকে এক বার টাকা ধার নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা রেখে দেওয়া মানে জোর করে একটা সঞ্চয় হয়ে যাওয়া। আর টাকা শোধ দেওয়ার ব্যাপারে প্রবল চাপ তো থাকছেই। এটা একটা স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা যেটা বন্ধন-এর মধ্যে দিয়ে কাজ করছে।
ঋণ শোধের এই আশ্চর্য মডেল বন্ধন ব্যাঙ্ক কতটা বজায় রাখতে পারবে? এটা পরিষ্কার যে, ব্যাঙ্ক হয়ে যাওয়ার পর শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ঋণে বন্ধন নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। কর্পোরেটদের বড় ঋণ দেওয়ার কথা বন্ধন এখনই ভাবছে না, কিন্তু মাঝারি মাপের ব্যবসায়ে ঋণ তো দিতেই হবে। মাঝারি মাপের ঋণগ্রহীতাদের সাপ্তাহিক মিটিং-এ রাজি করানো শক্ত। তাই বন্ধন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতি সপ্তাহের বদলে প্রতি মাসে মিটিং হবে। দল তৈরি করে তার সদস্যদের ব্যক্তিগত ঋণ দেওয়া হবে না কি সাবেকি প্রথায় সরাসরি ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া হবে, সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে, বন্ধন এখন জনসাধারণের টাকা ফিক্সড ডিপোজিট ছাড়াও সেভিংস এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা রাখতে পারবে, যে জমার ওপর গড় সুদের হার অনেক কম। ফলে বন্ধন-এর টাকা তোলার খরচ অনেকটাই কমবে। অন্যান্য ব্যাঙ্কদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সুবিধে হবে। কিন্তু সব থেকে বড় কথা, ঋণ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে বন্ধন যদি তার সদাসতর্ক নজরদারিটা চালিয়ে যেতে পারে, তা হলে যে শুধু তার নিজের উপকার হবে তা-ই নয়, এই লাগামছাড়া অনুৎপাদক সম্পদের ঋতুতে সমগ্র ব্যাংকিং দুনিয়ার কাছেও একটা ভাল বার্তা পৌঁছবে।
সোমদত্তা বসু, ফেলো, পিসিএওবি, ওয়াশিংটন ডিসি; সৌভিক দত্ত, শিক্ষক, আইআইএম ব্যাঙ্গালোর; অভিরূপ সরকার, শিক্ষক, আইএসআই, কলকাতা
মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত, কোনও প্রতিষ্ঠান এর জন্য দায়ী নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy