Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের পর চিন-ঘনিষ্ঠ কলম্বো কি দিল্লির সঙ্কট বাড়াবে

প্রতিবেশী নীতির চ্যালেঞ্জ

গত ২১ এপ্রিল এক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই ভয়াবহ ঘটনায় ২৬৯ জন প্রাণ হারান, আহত হন আরও অনেক মানুষ। এই সন্ত্রাসী হানা শ্রীলঙ্কাতে যে ধরনের ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, তারই সুবিধা পেয়েছেন গোতাবায়া।

অভিষিক্ত: শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ, অনুরাধাপুরা, ১৮ নভেম্বর। এএফপি

অভিষিক্ত: শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ, অনুরাধাপুরা, ১৮ নভেম্বর। এএফপি

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, ভোটের ফল তা হলে তেমনই হল শ্রীলঙ্কায়। যা ভোট পড়েছে তার ৫২.২৫ শতাংশ পেয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী গোতাবায়া রাজাপক্ষ। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমদাসার তুলনায় তিনি তেরো লক্ষ বেশি ভোট পেয়েছেন। সাজিথ পেয়েছেন ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট। বাকি ৩৩ জন প্রার্থী সমবেত ভাবে পেয়েছেন মাত্র ৫.৭৬ শতাংশ ভোট।

গত ২১ এপ্রিল এক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই ভয়াবহ ঘটনায় ২৬৯ জন প্রাণ হারান, আহত হন আরও অনেক মানুষ। এই সন্ত্রাসী হানা শ্রীলঙ্কাতে যে ধরনের ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, তারই সুবিধা পেয়েছেন গোতাবায়া। জাতিসত্তাগত মেরুকরণ তো আগে থেকেই ছিল। দেশের উত্তর ও পূর্বের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যুষিত এলাকাতে গোতাবায়া তেমন সুবিধে করতে পারেননি। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে ১৯৯৩ সালে তামিল জঙ্গিহানায় হত প্রেসিডেন্ট রণসিংহে প্রেমদাসার পুত্র সাজিথ। প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই সিংহলি বংশোদ্ভূত এবং ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু তামিলরাও ভোটের এই ফলে বেশ ত্রস্ত। কারণ, গোতাবায়ার অগ্রজ মাহিন্দা রাজাপক্ষ দেশের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই দেশের তামিল জঙ্গি আন্দোলনকে নির্দয় ভাবে দমন করা হয়েছিল। ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ঠিকই। কিন্তু তা হয়েছিল ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুদ্ধের শেষ লগ্নে অন্তত চল্লিশ হাজার নিরপরাধ তামিল মারা পড়েছিলেন। নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটে প্রচুর। আর এ সবই ঘটেছিল গোতাবায়ার নির্দেশে। প্রেসিডেন্ট দাদার প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে তিনিই নাকি ছিলেন দেশের সেনাবাহিনীর প্রকৃত কর্ণধার। এমন এক জন ব্যক্তি যে হেতু এ বার দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিচ্ছেন, তাই সংখ্যালঘুদের এই আতঙ্ককে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রসঙ্গত, নির্বাচনী জয়ের পরে গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন দেশের উত্তর-মধ্য অঞ্চলের শহর অনুরাধাপুরার উপকণ্ঠে এক বৌদ্ধ স্তূপে। তামিল শাসকদের পরাস্ত করবার পরে প্রথম সিংহলি রাজা দেশের ঐক্য প্রতিষ্ঠাকল্পে এই স্তূপটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজধানী কলম্বোর বাইরে এই প্রথম শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট যখন এমন এক স্থানকে নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিয়েছেন, তা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। নিছক প্রতীকী নয়।

বস্তুত, এপ্রিলের হিংসাত্মক ঘটনার পরে শ্রীলঙ্কার সিংহলি ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক শক্তপোক্ত সরকার ক্ষমতায় আসুক, এমনটাই চাইছিলেন। জয়ের পরে গোতাবায়া নিজেও স্বীকার করেছেন যে সিংহলি ও বৌদ্ধদের সমর্থন পেলেই যে জেতা সম্ভব, তা তাঁর জানাই ছিল। অর্থাৎ, তামিল বা মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোট তিনি পাবেন না, কিংবা তার তেমন প্রয়োজনও যে তাঁর ছিল না, নতুন প্রেসিডেন্টের কথাতেই তা স্পষ্ট। জয়ের পরে অবশ্য তিনি সবাইকে নিয়েই যে নতুন শ্রীলঙ্কা গড়তে চান এমন কথা বলেছেন। তবে, উচ্চারিত যা, তার বাইরে কিছু অনুচ্চারিত তাৎপর্যপূর্ণ কথা রয়ে গেল কি না, আগামী দিনে তা বোঝা যাবে।

জাতিগত সংঘাতের অন্য পিঠেই কিন্তু রয়েছে আর্থিক সঙ্কট। গত প্রায় দেড় দশক ধরেই শ্রীলঙ্কার আর্থিক মন্দা প্রকট। দেশি ও বিদেশি ঋণে এই দ্বীপরাষ্ট্র ইদানীং জর্জরিত। গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরে আর্থিক বিকাশের হার ছিল মাত্র ৩.২ শতাংশ। সার্বিক পরিস্থিতিতে এ বছরে তা আরও নিম্নগামী হবে, আশঙ্কা। তা ছাড়া, দু’কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষের দেশটিতে আর্থিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে চিনের শরণাপন্ন হয়ে শ্রীলঙ্কার জটিলতা বেড়েছে বই কমেনি।

বেজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মোদ্যোগ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে যুদ্ধ পরবর্তী শ্রীলঙ্কায় নতুন করে পরিকাঠামো নির্মাণের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দেশের দেনা ক্রমশ বেড়েছে। চিনের সহায়তায় নির্মিত হামবানতোতা বন্দরের ঋণ শোধে অপারগ হওয়ায় বছর দুয়েক আগে ওই বন্দরটি চিনকেই ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে ধার শোধের বিকল্প পথ খুঁজতে হয়েছে কলম্বোকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যও এখন ও দেশে অত্যন্ত বেশি। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির তুলনায় এই অসমতা সর্বোচ্চ।

রাজাপক্ষ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কলম্বো চিনের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। এই সময়েই কার্যত চিনের বলয়ে প্রবেশ করেছিল শ্রীলঙ্কা। আর এর ফলে নয়াদিল্লির উদ্বেগ খুবই বেড়েছিল। উদ্বেগের আরও কারণ চিনের একটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি ডুবোজাহাজের ওই পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার বন্দরে আগমন। এই ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই সাউথ ব্লকের কর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল। আর তাই ভারত তার দক্ষিণের এই প্রতিবেশী দেশটিতে বেজিংয়ের প্রভাব কমাতে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কার সদ্যপ্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের বিরোধ ঘনীভূত হওয়ায় নয়াদিল্লির কাছে সুবর্ণসুযোগ আসে। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যাওয়ায় ভারতের সুবিধাই হয়।

এই প্রেক্ষাপটে এ বারের নির্বাচনে গোতাবায়ার জয় কি নয়াদিল্লির সঙ্কট কোনও ভাবে বাড়াতে চলেছে? ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মত সে রকমই। কিন্তু অন্য কিছু তথ্যের পর্যালোচনাও পাশাপাশি জরুরি। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে গোতাবায়া জানিয়েছিলেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে তাঁর দাদা মাহিন্দাকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী করবেন। ইতিমধ্যেই তা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের অনুমোদনক্রমে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগ করতে পারেন। অতএব, মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রী হলে রাজাপক্ষদের আর এক ভাই বাসিলও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল। সে ক্ষেত্রে রাজাপক্ষ পরিবারতন্ত্র শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে এবং তা দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতান্ত্রিক গণতন্ত্রের নতুন নজির গড়বে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন শ্রীলঙ্কা সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে হবে। শুধু সত্তার রাজনীতি দেশের কঠিন সমস্যা মেটাতে পারবে না, তা গোতাবায়াও জানেন।

যুক্তি হতে পারে যে, এ রকম পরিস্থিতিতে কলম্বো চিনের দিকে ঝুঁকতেই পারে। বেজিংয়ের ‘চেকবই কূটনীতি’র সঙ্গে নয়াদিল্লির এঁটে ওঠা কঠিন বইকি! কিন্তু লক্ষণীয়, গত বছর দুয়েকে একাধিক বার মাহিন্দা এবং গোতাবায়া ভারত সফরে এসেছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছেন। শ্রীলঙ্কাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এর আগে ভারত ও চিন সম্পর্কে শ্রীলঙ্কার অবস্থান যেমনটি ছিল, তা অপরিবর্তিতই থাকবে, এমন কথা নিশ্চিত ভাবে বলবার সময় এখনই আসেনি।

গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী রাজাপক্ষ সরকারের দিক থেকে পশ্চিমি দেশগুলি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত দেশগুলি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কলম্বোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তামিলদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের। তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় নেতাদের শ্রীলঙ্কা-বিরোধী মনোভাব ভারত সরকারকে চাপে রেখেছিল। আর সেই সুযোগে চিন কলম্বো-ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পেরেছিল সহজেই।

ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কার চিন-প্রীতি দ্বীপরাষ্ট্রটিতেই অনেক প্রশ্ন তুলেছে। মাহিন্দা আর গোতাবায়া এক নন। কিন্তু নিজের মার্কিন নাগরিকতা এবং চিনের সম্ভাব্য প্রভাবের জুজু গোতাবায়া সরকারকে আমেরিকার কিছুটা কাছে নিতে পারে কি না, সেটাই দেখার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও গোতাবায়ার জয়ের অব্যবহিত পরে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রথম সুযোগেই স্বয়ং কলম্বো গিয়ে শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে এ দেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ২৯ নভেম্বরই তিনি এক দিনের ভারত সফরে আসতে চলেছেন। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফরই হবে ভারতে। নয়াদিল্লি অদূর ভবিষ্যতে প্রতিবেশীটিকে কাছে টানতে ও রাখতে, প্রাথমিক এই সুযোগ কতটা

কাজে লাগাতে পারে, সেটাই চ্যালেঞ্জ। তবে ভুললে চলবে না যে, এর পরেও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে এবং আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে শ্রীলঙ্কা চিনের মুখাপেক্ষী হতেই পারে। পাকিস্তান তো আছেই। ইদানীং নেপালের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের যে হাল হয়েছে, যে ভাবে কাঠমাণ্ডু ও বেজিংয়ের নৈকট্য বাড়ছে, তাতে শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে নয়াদিল্লিকে নতুন করে ভাবতে হবেই।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE