Advertisement
E-Paper

রমা কৈবর্ত, গফুর মিঞাদের বাদ দিয়েই কি ভারতের একতা গড়ে উঠবে!

অক্সিজেনের বিল মেটানো হয়নি বলে ভারতের হাসপাতালে আজও শিশুমৃত্যু হয়। সে দেশে এই মূর্তি কি খুব জরুরি ছিল? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।উচ্চতার রাজনীতি গোটা দুনিয়া জুড়ে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার আছে বলে, টোকিও টাওয়ার তৈরি হল জাপানে। ইজিপ্টে পিরামিড সুউচ্চ, অতএব ফ্রান্সকেও সুউচ্চ পিরামিড বানাতেই হবে। কাচের পিরামিড। এ এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
স্ট্যাচু অব ইউনিটি।—ছবি রয়টার্স।

স্ট্যাচু অব ইউনিটি।—ছবি রয়টার্স।

উচ্চতা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধরুন, আমি অমিতাভ বচ্চনের মতো লম্বা, আর আপনি হিন্দি ছবির অভিনেতা মুকরির মতো বেঁটে। সমস্যাটা জিন বিশারদ মেন্ডেলের। কিন্তু, আমি লম্বা। তাই আপনার পিঠে আমি হাত রাখতে পারি। আপনি খর্বাকার। তাই, আপনি আমার পিঠে হাত রাখতে পারবেন না। অতএব আমি ক্ষমতাবান আর আপনি দুর্বল। হ্যাভ এবং হ্যাভ নট। এই বিশ্লেষণের সময় অবশ্য আমরা মাননীয় হিটলার বা নেপোলিয়নের কথা ভুলেই যাই।

এই উচ্চতার রাজনীতি গোটা দুনিয়া জুড়ে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার আছে বলে, টোকিও টাওয়ার তৈরি হল জাপানে। ইজিপ্টে পিরামিড সুউচ্চ, অতএব ফ্রান্সকেও সুউচ্চ পিরামিড বানাতেই হবে। কাচের পিরামিড। এ এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা।

চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবিটা মনে পড়ে? স্তালিন এবং হিটলার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেছেন এক সেলুনের মধ্যে। এক বার স্তালিন তাঁর চেয়ারটা হিটলারের চেয়ে উপরে তুলছেন, আর এক বার হিটলার তার চেয়েও চেয়ার উঁচু করে দিচ্ছেন। এ ভাবে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় একটা সময়ের পর দু’জনেই চেয়ারের স্প্রিং ভেঙে নীচে পড়ে যাচ্ছেন।

ধান ভানতে এত উচ্চতার গীত কেন? এ জন্যই এত উচ্চতার কাহিনি, তার কারণ, আমরা আমাদের দেশে সর্দার বল্লভভাই পটেলের এক সুউচ্চ মূর্তি স্থাপন করেছি। ৫৯৭ ফুট উঁচু মূর্তি, এতো নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেয়েও বেশি লম্বা! স্ট্যাচু অব ইউনিটি। তুম ভি মিলিটারি। ম্যায় ভি মিলিটারি। তবে কি ভারত আমার ভারতবর্ষ, আমরা কি কোনও ব্যাপারে কম যাই নাকি! ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই মূর্তি নির্মাণের জন্য। নিন্দুকেরা যে কত কিছু বলেন! এই টাকায় নাকি ৫ লাখ ৯৮ হাজার স্কুলে শৌচালয় নির্মাণ সম্ভব হত। ৫ হাজার ২৯৬ জন শিশুকে মানুষ করা যেত। কিন্তু এই মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে এক দিকে গুজরাতি অস্মিতা, অন্য দিকে, গাঁধী এবং নেহরুকে ছোট করা— সুকৌশলে এ সব করা তো সম্ভব হচ্ছে। কংগ্রেসের মধ্যে বল্লভভাই পটেল আদিতে ছিলেন দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস। যেমন, নেহরু-সুভাষচন্দ্র বসুরা ছিলেন সমাজতন্ত্রী কংগ্রেস।

স্ট্যাচু অব ইউনিটি উদ্বোধনের পর নরেন্দ্র মোদী।—ছবি এএফপি।

বিজেপি চাইছে সুকৌশলে পটেলকে আত্মসাৎ করে ভারতদর্শনের এক নতুন পাল্টা আখ্যান রচনা করা। আচ্ছা, পটেল তো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরই নেতা। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তখন কোথায় ছিলেন আরএসএস নেতারা? ১৯২৫ সালে যে আরএসএসের জন্ম, তার আরও আগে আছেন সভরকর ও তাঁর হিন্দু মহাসভা। তার পর এসেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দীনদয়াল উপাধ্যায় থেকে ডঃ হেডগেওয়ার— মোদীজি আপনারা তো মনে করেন এরাই প্রকৃত ভারতরত্ন, তা হলে সভরকর বা গুরুজির মূর্তি স্থাপন করতেও তো পারতেন। কংগ্রেসের এক জন নেতাকে আত্মসাৎ করে তাতে গুজরাতি রং মাখিয়ে এ হেন উচ্চতা প্রদর্শন কিসের গৌরবগাথা?

৫৯৭ ফুট উঁচু মূর্তি উদ্বোধনের পর বাগ্‌বিস্তারও এখন কম হচ্ছে না। আসলে ভারত নামক শব্দটির দর্শন লুকিয়ে আছে তার আত্মায়। কোনও বিশাল মূর্তি দিয়ে আসলে তাঁকে পুজোর ছলে ভুলে থাকছেন শাসককুল। অক্সিজেনের বিল মেটানো হয়নি বলে ভারতের হাসপাতালে আজও শিশুমৃত্যু হয়। সে দেশে এই মূর্তি কি খুব জরুরি ছিল?

এই মূর্তি নির্মাণের জন্য এ দেশের ৭৫টি গ্রাম থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। যাদের পুনর্বাসন হল না, সেচের জলের ব্যবস্থা হল না, সে সব মানুষ রমা কৈবর্ত অথবা গফুর মিঞা— এদের বাদ দিয়েই কি ভারতের একতা গড়ে উঠবে!

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি নামক শক্তি ভারতকে এক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছেন। বাজপেয়ী-আডবাণীর যুগে বিজেপি ছিল জোট সরকার। সেই জোট সংস্কৃতির জন্যই না আসলে সে সময়ে বাজপেয়ী নিজেও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের মতাদর্শগত স্টিমরোলার চালানোর পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মোদী-অমিত শাহ চাইছেন এই সংস্কৃতির হেজিমোনি গড়ে তুলতে। রামমন্দির নির্মাণ হল একটা অংশ। আসলে এ হল একটা প্যাকেজ, যার মধ্যে সর্দার পটেলও আছেন, রামমন্দিরও আছে।

আচ্ছা বলুন তো, এ দেশের মানুষ কি সত্যিই এত বোকা! মানুষ দরিদ্র হলে কি বোকা হয়?

(অনিবার্য কারণবশত এই সপ্তাহে ‘শাহি সমাচার’ প্রকাশিত হল না)

Statue of Unity Narendra Modi BJP Gujrat Narmada River
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy