Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লাগাতার ধর্ষণের পরিণামে হয়ত মেয়েরা সতীত্ব নিয়ে আর মাথাই ঘামাবে না

ধর্ষণ শেষ হওয়ার পর বাচ্চাটিকে তুলে একটি কারখানায় আশ্রয় নেন ধর্ষিতা। ভোর হতে গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখান সারা রাত চুপ থাকা, এক বারও কেঁদে না ওঠা শিশুটিকে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৭ ১০:০০
Share: Save:

দি ন কয়েক আগে মেয়েটি, মানে যে পরে ধর্ষিতা হবে এবং আমরা যাকে এর পর থেকে ধর্ষিতা বলে সম্বোধন করব, করতে থাকব, সে একটু বেশি রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তার ছ’মাসের শিশুকন্যাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। অটোয় উঠলে তাকে জনা চারেক তাদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। বাচ্চাটি ঘুমোচ্ছিল, চেঁচামিচিতে উঠে পড়ে, তাতে ওই অটোযাত্রীরা, পরে যারা ধর্ষক হবে (বা আগেও হয়ে থাকতে পারে, জানা নেই), তাদের ধর্ষণের মুড-টা চলে যাচ্ছিল বলে বাচ্চাটিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ডিভাইডারে বাচ্চাটির মাথা থেঁতলে যাচ্ছে, মা দেখতে পান। কিন্তু কিছু করতে পারেন না। কারণ তিনি তখন ধর্ষকদের আওতায়। এর পর ধর্ষণ হয়।

যা শোনা গেছে, ধর্ষণ শেষ হওয়ার পর বাচ্চাটিকে তুলে একটি কারখানায় আশ্রয় নেন ধর্ষিতা। ভোর হতে গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখান সারা রাত চুপ থাকা, এক বারও কেঁদে না ওঠা শিশুটিকে। হাসপাতাল জানায় সে মৃত। বিশ্বাস না হওয়ায়, মেট্রো ধরে দিল্লির একটি হাসপাতালে ফের নিয়ে গিয়ে দেখান শিশুটিকে, তারাও একই কথা জানায়। এ বার মা, ভেঙে পড়েন।

বেশ। ধর্ষণের ঘটনা এখন নেহাত জলভাত হয়ে গিয়েছে। ও নিয়ে কেউ ভাবে না। বরং ধর্ষণ হওয়ার সময় কেমন পরিস্থিতি ছিল, সেটা অনেক উত্তেজক। ধরা যাক, মা বা বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ, মেয়ে বা ছেলের সামনে মা’কে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ— এ সবের খোঁজ বরং তবু খবরটার প্রতি একটু টান তৈরি করতে পারে। তবে মানতেই হবে, এই ছ’মাসের বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটি বোধ হয় অনেকেরই মন দ্রব করে তুলেছে। বাচ্চাটাকে না ছুড়ে দিলে কি এটা এত বড় খবর হত?

সত্যিই, একটা দেশে প্রতি দিন যদি এই হারে ধর্ষণ হতে থাকে, কতই বা বিচলিত হওয়া যায়! সব খবরই, যতই আবেদনময় বা স্পর্শকাতর হোক, এক সময় বোর লাগে। কিন্তু কিছু নাছোড় আর বদমাশ নিবন্ধকার মনে করে, যত বার এই অত্যাচার হবে, যত বার, তত বার এই ধরনের খবর হবে, এই লেখাও হবে। তাতে নতুন ধিক্কার, নতুন হুতাশ, নতুন অভিসম্পাত, নতুন আকুতি, কিছুই জন্মাবে না, তবু পুরনো কথাগুলোকেই ফের হাতুড়ির ঘায়ে লোকের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

এই খবরের একটা অংশ অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে— মেয়েটি প্রথমে একটি ট্রাকে উঠেছিল। ট্রাক ড্রাইভার তার শ্লীলতাহানি করতে যায়। তখন সে নেমে পড়ে। তার পর তাকে ধরে ওই পিশাচেরা। মানে, ট্রাক থেকে অটো রিকশা, একলা মেয়ে মানেই ঝাঁপিয়ে পড়ো। কারও কোনও ভিন্ন মত নেই। অটোয়, বাসে, ট্রেনে, রাস্তায়, বস্তিতে, পার্কে, সমুদ্রসৈকতে, সর্বত্র মেয়েকে একলা পেলেই ধর্ষণ করো।

মনে হয়, হাজারটা মৌলবাদী মিলে বহু দিন লাগাতার প্রচার করেও ভারতে যা করতে পারেনি, জাস্ট কয়েক বছরে এই ধর্ষকরা তা করে ফেলবে। সব তত্ত্ব আর স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষা শিকেয় তুলে, মেয়েরা এ বার বাড়িতে পরদানশিন হয়ে বসে পড়বে। শরীরের ওপর নিজের অধিকার, কাজ করার অধিকার, নিজের মতো সময় কাটাবার অধিকার, সব ভুলে শুধু শারীরিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে, ব্যথা থেকে বাঁচতে, তারা স্বেচ্ছায় পায়ে বেড়ি বেঁধে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে আর কাঁপবে। কোনও শাস্ত্র লাগবে না, খাপ পঞ্চায়েত বসাতে হবে না, মেয়েদের জিন্‌স আর মোবাইলই যে মেয়েদের ধর্ষণের জন্য দায়ী, সে আপ্তবাক্য প্রচার করতে হবে না। মেয়েরা রাস্তা দিয়ে একা গেলে, তাকে কেউ না কেউ ধর্ষণ করবে, এটা যেই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যাবে, গো-মাতার মতো সুশীলা হয়ে উঠবে মেয়েরা, ঐতিহ্যে উপচে পড়বে ভারত।

লাগাতার ধর্ষণের পরিণামে অবশ্য একেবারে একটা উলটো ব্যাপারও ঘটতে পারে। সতীত্ব নিয়ে মেয়েরা আর মাথা ঘামাবে না। বাসে-ট্রামে খুচরো অপমান নিয়ে যেমন তারা খুব বেশি মাথা ঘামায় না আর। বা গায়ে জলকাদা লাগলে যেমন লোকে ভাবে ‘ও বাড়ি গিয়ে ধুয়ে নিলেই হবে’, তেমনই, কোন অবমানব অথবা উপমানব কী ভাবে তার কদর্য কামনা উশুল করে নিল, সেই খারাপ-লাগাটাকে খুব বেশি আমল না দিতে শিখে যাবে এই দেশের মেয়েরা। পুরুষ-সমাজ যদি মেয়েদের চিনেবাদামের খোলা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো কিংবা রাস্তার কলের জলের মতো ব্যবহার করে, মেয়েরাও এক সময় এটাকে একটা বিশ্রী ও ঘিনঘিনে ঘটনা হিসেবে মেনে নেবে, বেশি পাত্তা দেবে না। বলবে, এই নে তোর ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত লজ্জা, কলঙ্ক, সতীত্বের ভুয়ো কলসি, এই আমিই আছড়ে ভাঙলাম। আর পরোয়া করি না, যা। ধর্ষণ হয়ে গেলে, মেট্রো ধরে নিজ কাজে চলে যাবে ভারতের নারী। সঙ্গে রেখে দেবে ধর্ষণ-স্পেশাল ফার্স্টএড বক্স। পাবলিক টয়লেটে গিয়ে লাগিয়ে নেবে অ্যান্টিসেপ্টিক। টপ করে জল দিয়ে গিলে নেবে পেন-কিলার। ব্যস।

শুধু মরা সন্তান বুকে থাকলে সেই দিন কান্নায় ভেঙে পড়বে, হাহাকার করবে। তবে সে দিনও নিজেকে অতিক্রম করবে, করতেই তো হবে। তাকে মেট্রো ধরে হাসপাতালে গিয়ে কমফার্ম করতে হবে শিশুর মৃত্যুকে, মর্গ থেকে ডেলিভারি নিতে হবে ফুটফুটে দেহ। তবে, ফেরার পথে যে সে পার পাবে, এমন আশ্বাস দেওয়া সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women Security Duty Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE