Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Economy

ম্যানেজার ছিলেন, এখন মজুর

বহু বছরের পরিশ্রম এবং পেশাদারি অভিজ্ঞতার ফলে কেরিয়ারের শীর্ষবিন্দুর কাছাকাছি পৌঁছে তাঁরা হঠাৎ দেখছেন সিঁড়িটাই সরে গিয়েছে।

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২০ ০১:৪৫
Share: Save:

সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুযায়ী অগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন এতে আহ্লাদিত হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র তথ্যসূত্র বলছে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ কাজ পেয়েছেন গত এক মাসে। অন্য দিকে, বেকারত্ব কমেছে সত্তর লক্ষের বেশি। কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির চেয়ে বেকারত্বের হ্রাস এতটা বেশি কী করে হয়? গুলিয়ে যাওয়া এই হিসেবের মানে হল, কাজের বাজার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন বিপুল সংখ্যক হতাশ মানুষ, অর্থনীতির সংজ্ঞায় যাঁদের আর বেকার হিসেবেও ধরা হবে না। তার চেয়েও ভয়ের কথা, যাঁরা আগে মাসমাইনে পেতেন, তাঁদের অনেকেই এখন দিন-আনা-দিন-খাওয়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বা পারিবারিক জমিতে উদ্বৃত্ত শ্রমের জোগান দিচ্ছেন।

সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, কাজ হারানো বেতনভোগীর একটা বিরাট অংশের বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। বহু বছরের পরিশ্রম এবং পেশাদারি অভিজ্ঞতার ফলে কেরিয়ারের শীর্ষবিন্দুর কাছাকাছি পৌঁছে তাঁরা হঠাৎ দেখছেন সিঁড়িটাই সরে গিয়েছে। হোটেল বা পর্যটনশিল্পের মতো ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক সংস্থা। কোথাও কোথাও ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য ছাঁটাই করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত উচ্চবেতনভোগী কর্তাস্থানীয়দের। অনেকে অভিযোগ করেছেন, এই চাকরির জগৎ কর্মীর অভিজ্ঞতার দাম দিতে চায় না, নামমাত্র বেতন ঠেকিয়ে অনভিজ্ঞ তরুণদের দ্বিগুণ খাটিয়ে কাজ তুলে নেয়। মার্কেটিং বা সেলসের মতো কাজে মাঝবয়সিদের কদরও কম। এই ধরনের পেশায় যুক্ত মাঝবয়সিদের মাথার উপরে তাই খাঁড়াটি ঝুলতেই থাকে, এক বার কাজ হারালে আবার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত, পৃথিবীর বহু দেশেই যেখানে অবসরের বয়স বাড়ানো হচ্ছে, এ দেশের কর্পোরেট কোম্পানিরা সেখানে পঞ্চাশোর্ধ্বদের অচ্ছুত মনে করছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব যাঁরা কাজ হারালেন, তাঁদের পারিবারিক দায়দায়িত্ব কিন্তু অনেক বেশি। অনেকেরই বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা, স্কুল বা কলেজ-পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। নিজেদের দৈনন্দিন ওষুধপত্রের খাতেও খরচ হয় অনেকটা। কাজের বাজার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো সঞ্চয়ও থাকে না বেশির ভাগের।

১৯৯৮ সালে চলুটেকা নদীর উপরে সেতুটি তৈরি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ অঞ্চলটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকে রক্ষা করতে। সেতুটি তৈরি হওয়ার মাসকয়েক পরেই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে এলাকাটি তছনছ হয়ে যায়। সেতুটির তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তার দু’দিকের সংযোগকারী রাস্তা। এমনকি গতিপথ পাল্টে ফেলে নীচের নদীটিও। দিকশূন্যপুরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির নাম লোকমুখে হয় ‘ব্রিজ টু নোহোয়্যার’। বিখ্যাত এইচ আর ফার্মের উপদেষ্টা মাঝবয়সিদের পরামর্শ দিয়েছেন, চলুটেকা ব্রিজের মতো হবেন না। নতুন ‘স্কিল’ অর্জন করুন, ফের বাজারোপযোগী হন।

বাস্তবে কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সমবেতনের বিকল্প কাজ পাচ্ছেন না এই মানুষেরা। সংবাদপত্রে প্রকাশ, কর্মসূত্রে দেশেবিদেশে ঘোরা নামকরা রেস্তরাঁর ম্যানেজার এখন বৃহন্মুম্বই কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার ট্রাকে সহকারীর কাজ করছেন। ট্রাক-পিছু মিলছে পঞ্চাশ টাকা। গোয়ায় সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই এখন রাস্তায় বসে মাছ বিক্রি করছেন। যাঁদের পর্যাপ্ত সঞ্চিত অর্থ আছে, তাঁরা হয়তো ভাবছেন নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার কথা।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হয় তার কাজের বাজারের অসংগঠিত ক্ষেত্রটি। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কিন্তু তা হয়নি। এ দেশে কর্মনিযুক্তদের আশি শতাংশের বেশি কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে প্রাক্-অতিমারি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপরের ধাপে যাঁদের অবস্থান, তাঁদের সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিশেষত এঁদের মধ্যে যাঁরা উচ্চবর্ণ হিন্দু, তাঁদের। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের নীচের ধাপে যাঁরা, তাঁদের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত। আর সংগঠিত ক্ষেত্রের বেতনভোগীরা পেশা পরিবর্তন করেন সবচেয়ে কম। অতিমারির ধাক্কায় শেষোক্ত শ্রেণিটি হয়তো সেই কারণেই এমন লবেজান হয়ে পড়েছে। ভারতে শ্রমের বাজারের হাজারো অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও হয়তো একটা সুরক্ষাবলয়ের মধ্যেই বসবাস করতেন তাঁরা। নিতান্ত বাধ্য না হলে ভাবতেন না পেশা পরিবর্তনের কথা।

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে যে মহামন্দা হয়েছিল, তার ফলে আমেরিকা-সহ উন্নত বিশ্বের চারটি দেশে আত্মহত্যার হার বেড়েছিল ষোলো শতাংশ। দ্য ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের মতে, বর্তমান সঙ্কটকালে কাজ হারানোর ফলে আত্মহত্যা করতে পারেন প্রায় দশ হাজার মানুষ। এলিজ়াবেথ ম্যাকব্রাইড নামের এক ফ্রিল্যান্স লেখক দ্য অ্যাটলান্টিক পত্রিকায় লিখেছেন তাঁর প্রপিতামহ রয় এল হাম্পফ্রির জীবনের এক অধ্যায়ের কথা। রয়ের কথা জানতে চাইলে হঠাৎ চুপ করে যেতেন তাঁর পরিবারের প্রবীণেরা। কানাঘুষোয় এলিজ়াবেথ শোনেন ট্রেনের সামনে মাথা ঘুরে গিয়ে চাপা পড়েন তাঁর দাদুর বাবা। সে কথা তাঁর বিশ্বাস হয়নি। দস্তুরমতো গবেষণা করে তিনি জানতে পারেন, মহামন্দার সময়ে কাজ হারান পেশায় উকিল রয়। তার পরে বহু চেষ্টায় জোগাড় করেন কাস্টমস ইনস্পেক্টরের কাজ। দড়ির মই বেয়ে জাহাজের উপরে উঠতে হত এই ইনস্পেক্টরদের। নীচের ডেকে ঠাসা থাকত জন্তুজানোয়ার। মৃত পশুর গন্ধে অসুস্থ বোধ করতেন তাঁরা। কেউ কেউ দূষিত জলে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাতেন। ওকালতি ছেড়ে এমন পেশায় মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। অনেক খুঁজে ১৯৩৭-এর একটি স্থানীয় খবরের কাগজে এলিজ়াবেথ দেখেন, ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন রয় এল হাম্পফ্রি নামের বছর ষাটেকের এক পুরুষ। তাঁর পকেটে ছিল দু’টি চিঠি। একটিতে কাস্টমসের কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। অন্যটি চার দিন পরের। ওই কাজেই আবার নিযুক্ত হতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

মন্দা আসে মন্দা যায়। শতাব্দী পার করেও কাজের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা কমে না এতটুকুও।

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economy Unemployment Coronavirus in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE