Advertisement
E-Paper

মোদীর কেন যোগী চাই

‘আবার বৌ! একেবারে উদোর মতো অবস্থা হয়েছে দেখি তোর।’ টিপ্পনী কাটে তপেশ। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। বিয়ের পর থেকে সবেতেই শিশিরের বৌয়ের কথা মনে পড়ে যায়।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০

একটা টিভির দাম সাড়ে চার লাখ টাকা! আমার বৌ তো দাম দেখে প্রায় মুচ্ছো গিয়েছিল।’ একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল শিশির।

‘আবার বৌ! একেবারে উদোর মতো অবস্থা হয়েছে দেখি তোর।’ টিপ্পনী কাটে তপেশ। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। বিয়ের পর থেকে সবেতেই শিশিরের বৌয়ের কথা মনে পড়ে যায়। আজ অবশ্য অন্য গল্প। দিন কয়েক ধরেই বাড়ির টিভিটা বিগড়োচ্ছে। আজ বৌকে নিয়ে শো-রুমে যাবে, জানিয়েই গিয়েছিল।

‘তার পর? সাড়ে চার লাখের টিভিটার দিকে আর তাকালি না তো?’ জানতে চান শিবুদা।

‘খেপেছেন?’ গোপাল এর মধ্যেই চা দিয়ে গিয়েছে শিশিরের সামনে। একটা লম্বা চুমুক দিয়ে শিশির জানাল, লাগসই দামের একটা মডেল কিনে, কিস্তির বন্দোবস্ত করে এসেছে। কাল ডেলিভারি।

‘তা হলে বলছিস, সাড়ে চার লাখের টিভি তোকে মোটে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারল না?’ শিবুদার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির ইঙ্গিত। শিশির উত্তর দিতে গিয়েও চুপ করে গেল।

‘উইলিয়াম সোনোমা নামে একটা অ্যামেরিকান কোম্পানি আছে, বুঝলি।’ বলতে থাকেন শিবুদা। ‘রান্নাঘরের সরঞ্জাম বানায়। বছর ত্রিশেক আগে তারা বাজারে আনল একটা ব্রেড মেকার। বাড়িতে পাঁউরুটি তৈরির মেশিন। ২৭৫ ডলার দাম। সে যন্ত্র আর বিক্রি হয় না। পাঁউরুটি তো পাড়ার দোকানেই অঢেল কিনতে পাওয়া যায়। খামকা অতগুলো টাকা দিয়ে যন্ত্র কিনবে কে? মডেলটা তুলেই দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন ঠিক হল, একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। এক মার্কেটিং রিসার্চ কোম্পানিকে ডেকে আনা হল, কী করে ব্রেড মেকারের বিক্রি বাড়ানো যায়, দেখার জন্য।’

‘শিবুদা, এ যে দেখি ধান ভানতে শিবের গীত আরম্ভ করলেন। ব্রেড মেকারের গল্পে শিশিরের টিভি কোথায়?’ মাঝপথেই বাধা দেয় তপেশ।

‘অবান্তর কথা বলা শিবু সেনের স্বভাব নয়, তপেশ।’ ধমক দেন শিবুদা। ‘টিভি বিলক্ষণ আছে। শোন। তো, সেই মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করল। ডিসকাউন্ট-টাউন্ট নয়, চার আনাও দাম কমাল না ব্রেড মেকারের। বরং বলল, ওটার চেয়ে বড় একটা ব্রেড মেকার বাজারে আনতে হবে। দাম হবে দেড় গুণ। উইলিয়াম সোনোমা-র কর্তাদেরও কী মনে হল, মেনে নিল সেই পরামর্শ। দেখা গেল, সত্যিই হুহু করে বিক্রি হচ্ছে ব্রেড মেকার। বড়টা নয়, গোড়ায় যেটা দোকানের তাকে পড়ে থেকে পচছিল, সেই মডেলটাই। রাতারাতি বেস্টসেলার। কেন, সেটাই সা়ড়ে চার লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু, তার আগে, সূর্য, একটা সিগারেট দে বাবা।’ নিজের খালি প্যাকেটটা এক বার ঝাঁকিয়ে দেখে নিলেন শিবুদা।

‘ওই মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির সঙ্গে ড্যানিয়েল কানেম্যান-এর যোগাযোগ ছিল কি না, বলতে পারব না,’ সিগারেটে গোটা দুয়েক টান দিয়ে বললেন শিবুদা। ‘কানেম্যান কে জানিস তো? প্রিন্সটন-এর সাইকোলজির প্রফেসর। মনস্তত্ত্বের একমাত্র অধ্যাপক, যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষ আসলে দাম-কানা। যে জিনিসটা কেনার অভ্যাস নেই, সেটার দাম যে আসলে কত হওয়া উচিত, মানুষ জানে না। ব্রেড মেকার নামক বস্তুটির দাম কত হতে পারে, স্বভাবতই কেউ জানত না। ফলে, ২৭৫ ডলার খরচ করে জিনিসটা কেনা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে বেশির ভাগের মনেই সন্দেহ ছিল। নতুন মডেলটা সেই সন্দেহই কাটিয়ে দিল। দোকানে ঢুকে মানুষ দেখল, একই জিনিস, একটা ছোট আর একটা বড়। আসলে দেখল, বড়টা দামি, আর ছোটটা সস্তা। ছোটটা যে সস্তা, সেটা বোঝানোর জন্যই আসলে বড়টার দরকার ছিল। এই যেমন, শিশির যে টিভিটা কিনল, সেটার দাম যে একদম ন্যায্য, সাড়ে চার লাখ টাকার টিভিটা না থাকলে শিশির জানত?’

‘তিমিঙ্গিল!’ বলল সূর্য।

‘যা বলেছিস। মোদীকে চেনার আগে ভারত কি জানত যে লালকৃষ্ণ আডবাণী বেচারা একেবারে নরমপন্থী নেতা? বাবরি মসজিদটা জাস্ট ভুল করে ভেঙে ফেলেছিল!’ এত ক্ষণে কথা বলে শিশির।

‘মোক্ষম উদাহরণ!’ কথাটা লুফে নেন শিবুদা। ‘এই যে নরেন্দ্র মোদীর পাশে এক জন যোগী আদিত্যনাথকে খাড়া রাখতে হয়, সেটাও আসলে অ্যাঙ্করিং-এরই খেলা। বিষম খাসনি, অ্যাঙ্করিং কাকে বলে, বলছি। কানেম্যান আর তাঁর দীর্ঘ কালের সহকর্মী অ্যামস টস্‌কি কথাটা তৈরি করেছিলেন। একটু আগে বললাম না, মানুষ দাম-কানা— আসল কথাটা হল, শুধু দাম নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ একেবারে ধারণাহীন। দুনিয়ার মহাসাগরে খাবি খাচ্ছে। তার দিকে খড়কুটো এগিয়ে দিলেই সে আঁকড়ে ধরে। বড় ব্রেড মেকারটা তেমনই খড়কুটো ছিল। সাড়ে চার লাখের টিভিটাও।

‘মোটামুটি একই গোত্রের দুটো জিনিস, কিন্তু কোনও একটা দিকে ফারাকও আছে— এমন দুটো জিনিসের মধ্যে একটার দাম শুনলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অ্যাঙ্কর। নোঙর। যাতে নৌকো বেঁধে মানুষ অন্য জিনিসটার দাম আঁচ করতে চায়। সবচেয়ে মজার কথা কী জানিস, কানেম্যান আর টস্‌কি হাতেকলমে দেখিয়েছিলেন, এই আঁচ করার কাজে আমরা একেবারে হদ্দ কাঁচা। দামি জিনিসের দাম জানলে কম দামিটার ক্ষেত্রে আমরা আসল দামের চেয়ে বেশি ধরি। আবার, কম দামির দাম জানলে দামির ক্ষেত্রে যথেষ্ট দামে পৌঁছতে পারি না।’

‘মোদীর কথাটা ভুলে গেলেন তো।’ খেই ধরিয়ে দেয় তপেশ।

‘ভুলিনি, ভুলিনি। কিন্তু তার আগে বল দিকি, রেস্তরাঁয় গিয়ে মেনুটা কখনও খুঁটিয়ে দেখেছিস? দেখবি, একটা খাবার থাকবেই, যার পাগলের মতো দাম। ওটা কিন্তু হাতির খাওয়ার দাঁত নয়, দেখানোর দাঁত। ওইটে হল খড়কুটো— অ্যাঙ্কর— যেটা অন্য খাবারের দামগুলোকে তোর কাছে যুক্তিযুক্ত করে তুলবে। এর একটা পোশাকি নাম আছে। ‘ডিকয় এফেক্ট’। বাংলায় বললে, ধোঁকার টাটি। ওর একমাত্র কাজ তোর জন্য অ্যাঙ্কর তৈরি করে দেওয়া। আদিত্যনাথও তেমন। ওকে দেখে তুই বুঝবি, অতখানি হিন্দুত্ববাদ ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু, কতটা গ্রহণযোগ্য? অ্যাঙ্কর থেকে এ বার আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাক। যতটা নামা দরকার, ততটা পারবি না কিছুতেই। এসে মোদীতে দাঁড়াবি। গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে মোদীর।’

‘যা বলেছেন। আমার যেমন শাশুড়ির মেজাজ দেখলে বৌকে শান্তশিষ্ট মনে হয়।’ শিশির বলল।

‘আবার, আবার!’ রব তোলে তপেশ আর সূর্য।

‘আচ্ছা, বৌয়ের কথা বলব না, থাক।’ মুখ ব্যাজার করে শিশির। তার পরই বলে, ‘সে দিন জুতো কিনতে গেলাম। দাম দিচ্ছি, এমন সময় সেল্স-এর ছেলেটা একটা পালিশ বের করল। ওতে নাকি চামড়ার অনন্তযৌবন থাকে। দাম যা বলল, দেখলুম জুতো ফেলে পালিশ কিনতে হবে। বললাম, অনেক দাম। তখন ছোকরা একটা ছোট শিশি দিল। তার দামই সাড়ে তিনশো টাকা। কিনে ফেললাম। অ্যাঙ্কর তৈরি করে বেচল, তাই না?’

‘ধরে ফেলেছিস।’ শিবুদার চোখে প্রশংসার হাসি। ‘কিন্তু, ঠেকাতে পারবি না, বুঝলি। পরের বারও অ্যাঙ্কর এসে তোকে পেড়ে ফেলবে।’

আর এক দফা চা দিয়ে যায় গোপাল। সূর্যর প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট ধরান শিবুদা। দেশলাই বাক্সটা বাঁ হাতের তিন আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে খানিক আপন মনেই বললেন, ‘গোলমালটা ভাব। যে কোনও একটা দাম ধরিয়ে দিলেই তুই তাতে আটকে যাবি। যতই চেষ্টা কর, সেই অ্যাঙ্কর থেকে তোর মুক্তি নেই। গড়িয়াহাটে হকাররা যে আকাশছোঁয়া দাম হাঁকে, সেটা ইয়ার্কি নয়। ধর শিশিরের বৌ একটা কুর্তা কিনবে, দর করে দিতে হবে শিশিরকেই— হুঁ-হুঁ বাবা! হকার হাঁকল, এগারোশো টাকা। পাশেরটাকে দেখিয়ে বলল, এটা নশো। শিশির প্রাণে ধরে দুশো টাকা বলতেই পারবে না। অনেক চেষ্টা করেও বলবে ছশো, তার পর সাড়ে সাতশো টাকায় কিনে ফেলবে। আমি হলে অবশ্য সাড়ে আটশো খসত। এই যে তুই আজ অ্যাঙ্করিং-এর কথাটা জানলি, তার পরও কিন্তু দর করতে পারবি না। কারণ, কুর্তার মতো চেনা জিনিসেরও ঠিক দাম কত হওয়া উচিত, আমরা নিশ্চিত করে জানি না।’

‘সর্বনাশ করেছে’, আঁতকে ওঠে তপেশ, ‘দোকান বাজারে যাওয়া ছেড়ে দেব নাকি?’

‘তা ছাড়িস না, কিন্তু যেখানে দরদস্তুর হবে, সেখানে প্রথম দামটা অবশ্যই তুই বলবি। অ্যাঙ্কর সেট করার সুযোগই দিবি না। কত করে দেবে, জিজ্ঞেস করলি কী গেলি।’ উত্তর দেন শিবুদা।

‘কিন্তু টিভির শো-রুমে, রেস্তরাঁয়, জুতোর দোকানে— ও শিবুদা, সবখানেই তো অ্যাঙ্কর।’

‘কী আর করবি। ধোঁকার টাটির গল্পটা জানলি, এ বার থেকে দামি জিনিস দেখলেই সাবধানে থাকবি। তোর মাথা তোকে সাহায্য করবে না— তোর মাথার দোষ নয়, অ্যাঙ্করিং-এর সামনে আমাদের সবার মাথাই নাচার— তবুও নিজেকে বলবি, ওই জিনিসটা আমায় টুপি পরানোর জন্যই আছে। জুতো পালিশের ক্ষেত্রে বলতে না পারিস, আদিত্যনাথকে দেখে বলবি। নয়তো, কাল আর কোনও নেতা আসবে, যাঁকে দেখে মোদী কোন ছার, আদিত্যনাথকেও পছন্দ হবে।’ মুচকি হাসেন শিবুদা।

Narendra Modi Yogi Adityanath BJP L. K. Advani
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy