ব্রিটেনের একটি স্কুলে আট বৎসরের এক বালককে সম্ভাব্য জঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত করিয়া সরকারি সন্ত্রাস নিবারণ কর্মসূচির আওতায় আনা হইয়াছে। বালকটির অপরাধ, সে মহম্মদ-উত্তর ধর্মগুরু, প্রথম খলিফা আবু-বকর আল-সিদ্দিকির নামাঙ্কিত টি-শার্ট পরিয়াছিল। তাহার স্কুলের শিক্ষকরা পোশাকটি দেখিয়াই ধরিয়া লন, সেখানে লেখা আছে আবু-বকর আল-বাগদাদি’র নাম, যে কিনা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-এর প্রধান। স্কুল কর্তৃপক্ষ বালকটিকে সন্ত্রাসের পথ হইতে নিরস্ত করিবার জন্য দ্রুত ‘সমাজসেবা’য় পাঠাইয়া দেন। জিজ্ঞাসাবাদ চলে। জানা যায়, ছাত্রটি আইএস বিষয়ে কিছুই জানে না। কিন্তু তাহার নামে একটি রিপোর্ট তৈয়ারি হয়। সেই রিপোর্টে তাহার সম্পর্কে ‘সতর্কবাণী’ নথিভুক্ত হইয়াছে। ভয়ানক উদাহরণ? তবে বলা দরকার, ব্রিটেনেই এমন উদাহরণ আরও আছে। কয়েক মাস আগে একটি বছর ষোলোর ছাত্রকে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ প্রচারের দায়ে পুলিশ সে দেশের সন্ত্রাস দমন আইন মোতাবেক জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছে। প্যালেস্টাইনের মুক্তি চাহিবার মানেই সন্ত্রাস নয়— এই কথা বুঝিতে প্রশাসনের চালকরা অসমর্থ। উদাহরণ বাড়ানো যায়, কিন্তু তাহা নিষ্প্রয়োজন।
দৃষ্টান্তগুলি ভয়ানক বিভ্রান্তির প্রমাণ। কিন্তু সেই ভ্রান্তির মূলেও ভয়। যে ভয়ের উৎস ‘অপর’। একটি বহুমিশ্র সমাজে ‘অপর’ তৈয়ারি হয় কী ভাবে? অপরিচয় এবং অজ্ঞানতা হইতে। অপর সম্পর্কে জানার অনীহাই নয়, নিজের ভয়ের কুমন্ত্রণায় সেই অপরকে ক্রমাগত শত্রু ভাবিয়া দূরে ঠেলিয়া দেওয়ার মানসিকতাই এ ক্ষেত্রে সক্রিয়। এই ভয় পাওয়াকে ‘অপর’ও ভীত করে। আর তাই ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস ও ভুল বোঝাবুঝির এক বিরাট বৃত্ত জন্ম লইতেছে। অবিশ্বাস কালক্রমে পরিণত হইতেছে হিংসায়। আর সেই লালিত হিংসাই মানুষকে তাড়িত করছে অপরাধের পথে। ইহা কেবল বিষচক্র নয়, বিষ ক্রমশ তীব্র হইতে তীব্রতর। ব্রিটেনের মতো বহুসংস্কৃতিবাদী দেশে যখন এই দুষ্টচক্র সক্রিয় হয়, তখন বোঝা যায় কোথাকার পৃথিবী কোথায় গড়াইয়াছে। এই পৃথিবীর প্রকটতম দৃষ্টান্ত অধুনা আটলান্টিকের অন্য পারে প্রতিনিয়ত উদ্ভাসিত। তাহার নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুসলমান হইতে মেক্সিকান— রকমারি ‘অপর’ সম্পর্কে অপরিচয়, ভীতি এবং হিংসাকে পুঁজি করিয়া তিনি ভোটব্যাঙ্কে আমানত বাড়াইতেছেন। কিন্তু এই ব্যাধির তিনি চরম রূপ, বিরল রূপ নহেন। ইউরোপও একই জীবাণুতে আক্রান্ত। যে মহাদেশ এক কালে সমগ্র পৃথিবীর সম্মুখে দ্বার খুলিয়া দিয়াছিল, আজ সেখানে দেশে দেশে অভিবাসীদের জন্য প্রত্যাখ্যানই বরাদ্দ।
এই ব্যাধির এক এবং এক মাত্র উপশম: অপরকে জানিবার, চিনিবার এবং বুঝিবার চেষ্টা করা। কেবল ভীত হইয়া অপরের সম্মুখে দেওয়াল তুলিলে সম্ভাব্য বিপদটি জানাও যাইবে না। ভয় মানুষকে কোথায় লইয়া যাইতে পারে, আট বৎসরের বালকটিকে জঙ্গি বলিয়া দাগাইয়া দেওয়ার ঘটনাতেই তাহা স্পষ্ট। এই বালক যে স্বেচ্ছায় জঙ্গি হইতে পারে না, তাহা বুঝিবার নিমিত্ত একটি কাণ্ডজ্ঞানী মনের প্রয়োজন। অপরিচয় এবং ভয় কাণ্ডজ্ঞানকে হরণ করিতেছে। যত ক্ষণ না এই ভয় কাটাইয়া ‘অপর’কে চিনিবার চেষ্টা সফলতা লাভ করিবে, তত দিন বিষচক্র উত্তরোত্তর স্বাভাবিক বুদ্ধিকে গ্রাস করিবে। আমেরিকা, ব্রিটেন বা ইউরোপে যেমন, ভারতেও তেমনই। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই দুর্লক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই প্রতি দিন দেশ জুড়িয়া ফুটিয়া উঠিতেছে।