ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু আটলান্টিক পার হইয়া নির্বাচনী বক্তৃতা দিয়া আসিয়াছেন। জিতুন বা হারুন, তাঁহার এই অতুল কীর্তি ইতিহাস ভুলিতে পারিবে না। রিপাবলিকান সেনেটরদের আমন্ত্রণে মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতা দিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও হোয়াইট হাউসের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি লইতেও তিনি দ্বিধা করেন নাই। প্রেসিডেন্ট ওবামা যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ পর্যন্ত করিলেন না এবং বিদেশ সচিব জন কেরি যে তাঁহার কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণকে ‘ভুল’ আখ্যা দিলেন, এই অপমান হজম করিতেও তাঁহার দ্বিধা নাই। কারণ তিনি ইরানের সহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ছয় রাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি সম্পাদনের বিরুদ্ধে তাঁহার তীব্র আপত্তি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রবল ভাবে পেশ করিতে পারিয়াছেন। তাঁহার যুক্তি: এই চুক্তি ইরানকে পরমাণু বোমা বানাইতে সাহায্য করিবে, আর সেই বোমায় সজ্জিত ইরান ইজরায়েলকে ধ্বংস করিতে উদ্যত হইবে।
নেতানিয়াহুর যেমন কট্টর জায়নবাদী অবস্থান গ্রহণের রাজনৈতিক তাগিদ আছে, রিপাবলিকানদেরও তেমনই ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধাচরণের দায় আছে। আর তাহার ফলেই সরকারি মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিবেন জানিয়াও রিপাবলিকানরা ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে কংগ্রেসে ভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানান। এক হিসাবে ইহাও এক নজিরবিহীন ঘটনা, যেমন বেনজির ঘটনা অতিথি রাষ্ট্রের প্রধানকে ডিঙাইয়া তাঁহার বিরোধী পক্ষকে তুষ্ট করিতে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এই সফর। কিন্তু নেতানিয়াহু স্পষ্টতই ইতিহাসের গতির বিপরীতে পদচারণা করিতেছেন। ইরান যাহাতে দ্রুত পরমাণু বোমা বানাইয়া ফেলিতে না পারে, সে জন্যই আমেরিকা সহ ছয়টি শক্তিধর রাষ্ট্র তাহার সহিত চুক্তিবদ্ধ হইতে চায়। এই চুক্তি ইরানের হাত-পা বাঁধিয়া ফেলার আয়োজন, তাহার পরমাণু কর্মসূচিতে লাগাম পরাইবার প্রয়াস। অন্তত বোমা নির্মাণের প্রক্রিয়াকে যত দূর সম্ভব বিলম্বিত করার রুদ্ধশ্বাস প্রচেষ্টা এই বহুজাতিক দরকষাকষির মধ্যে নিহিত। কিন্তু ইজরায়েলের বহু অঘোষিত পরমাণু বোমা থাকিলেও ইরান তাহা বানাইয়া ফেলিলে কী হইবে, সেই আতঙ্ক প্রচার করিয়া তিনি ভোটযুদ্ধ তুঙ্গে তুলিতে চাহেন। তাহাতে উগ্র জাতীয়তাবাদ পুষ্ট হইবে এবং তাহাতে ভর দিয়া নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টিও নির্বাচনী বৈতরণী পার হইয়া যাইবে, ইহাই তাঁহার আশা।
আরব-মুসলিম বিশ্বের ঘেরাওয়ের মধ্যে বিকশিত ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে জায়নবাদীরা নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বারংবার ব্যবহার করিয়াছে। প্যালেস্টিনীয়দের স্বদেশ দখল করিয়া তাহাদের কার্যত দুইটি সংকীর্ণ ভূখণ্ডে (গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক) আটকাইয়া রাখিয়া নিয়মিত তাহাদের মানবাধিকার খর্ব করার বাস্তবতা হইতে নজর ঘুরাইতেই ইরানের পরমাণু অস্ত্রসজ্জার কাল্পনিক ভীতি প্রচার করা হইতেছে। এ কথা মনে করিবার কারণ আছে যে, ইরান পরমাণু প্রযুক্তি আয়ত্ত করিতে চাহে। কিন্তু তাহাতে অন্যায় কিছু নাই। প্রযুক্তি-বিপ্লবের বর্তমান যুগে তাহা আয়ত্ত করা এমন কিছু অসম্ভবও নয়। ইরান যাহাতে প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, জ্বালানির মতো বিষয়ে তাহার উপযোগ ইত্যাদিতে প্রযুক্তিটিকে সীমাবদ্ধ রাখে, সে জন্য চেষ্টা করাই জরুরি। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁহার ইউরোপীয় সহযোগীরা এবং রাশিয়া ও চিন ঠিক সেই কাজটিই করিতেছেন। রিপাবলিকান সেনেটররা তাহার তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে নারাজ অথবা ব্যর্থ। আর সেই সুযোগটিই কাজে লাগাইলেন নেতানিয়াহু।