পুজোর মুখে আমরা ঘর ঝাড়ি, জিনিসপত্রের তাক ঝাড়ি, সিলিং আর জানলা-দরজার ঝুল ঝাড়ি, পোকা ধরার ভয়ে ভাদ্র-আশ্বিনের ঝামরে-পড়া রোদ্দুরে জামাকাপড় মেলে দিই, কিন্তু আমাদের মন? শত-শত বছরের অপরিস্রুত, তমসা-মাখা মন, তার কী ব্যবস্থা নিই বলুন তো? আসুন, দেবীপক্ষ আসার আগেই কতকগুলো অবশ্য-কাজের ফিরিস্তি, হৃদয়ে ট্যাগ করে নিই আমরা। সেগুলোই হবে আমাদের মনের ঝুলঝাড়ু। মনকে ধুলো ঝেড়ে সাফসুতরো করে দেবে একদম।
আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, এই আত্মকণ্ডূয়নের সুর বাজিয়ে তো দিব্যি চলল এত দিন। বাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্কদের প্রতি উদাসীন থেকে, কানে বোতাম টিপে একা একা গানবাজনা উপভোগ করা হল জানলার বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে। পাশের বাড়ির আর্তনাদ চেপে দেওয়া হল ভারী পর্দা টেনে দিয়ে। বা রে! ছেলের সেকেন্ড সেমেস্টার চলছে না! এই সব ঝুলকালির আস্তরণ সরিয়ে, এ বার পুজোর আগে পড়শির খোঁজ নিন, অবসাদ-আচ্ছন্ন বন্ধুর জন্য মাথা খাটিয়ে বের করুন নিত্যনতুন বেঁচে থাকার খোরাক। দেখুন, শরতে কেমন ঝকমক করে উঠল আপনার পুরনো আসবাবগুলো, আনন্দে!
ওকে মনে আছে? লাল টেপজামা-পরা খুকিটিকে? ক্লাস টু হয়নি এখনও। বাড়ি ফিরে মুড়ি খাবে, তাই মুদির দোকানে গিয়েছিল। ফিরল, রক্তাক্ত। প্রাণে বেঁচে ভাল করেনি মোটেই। সবাই ওকে দেখলে, ওর বাবা-মা’কে দেখলে ফিসফিস, গুজগুজ শুরু করে দেয়। ওর হাত ধরে পরম আদরে নিয়ে আসুন চাঁদোয়ার নীচে। খুকিকে দিয়েই না-হয় শুরু করা যাক এ বারের কুমারী পুজোটি। মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে, তবেই।
পুত্রবধূকে সহ্য হচ্ছে না একদম? বিয়ের সময়, যেহেতু লাভ ম্যারেজ, মেয়ের বাড়ি থেকে কিছুই প্রায় দেয়-থোয়নি! আর, আপনিও তো সেই কবে, কনেবউ হয়ে এসে থেকেই এ বাড়িতে পিতৃতন্ত্রের অত্যাচারের শিকার হয়ে গেছেন! এখন, বউমাটিকে জব্দ করে তার শোধ তুলতে হবে না বুঝি? আর এই যে আপনি, এই পরিবারের পুত্রবধূটি, আপনিও তো অলরেডি ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, এক বার শ্বশুরশাশুড়িকে দেশের বাড়িতে পার করে দিতে পারলেই আপনার ছেলেমেয়ের ছিমছাম ‘স্টাডি’ হয়ে উঠবে ওঁদের ঘর। আপনার স্বামীও বলছেন, ব্রিদিং স্পেসের বড় অভাব। শুনুন, পরিবারের সবাই সবাইকে কষে ভালবাসতে শুরু করুন। কিংবা, যাঁদের বাবা-মা, অথবা দেখার কেউ নেই এমন বৃদ্ধ আত্মীয়স্বজন রয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে, পুজোর ক’দিন তাঁদের নিয়ে আসুন বাড়িতে, ভোররাতে কলাবউ স্নান করানোর আগেই। নিজেদের মনকে যদি এ ভাবে স্নান দিয়ে নেন এক বার, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারবেন! এমন ঝলমল করে উঠবেন যে, তখন কোথায় লাগে হিরে-মুক্তোর সাজ!
হাউজিং কমপ্লেক্সের একটা একটেরে ফ্ল্যাটে অনেক তদবির-তদারক করে উঠে এসেছেন এক ভিনধর্মী পরিবার। এখন তো আর কার্যত কারও ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দেওয়া যায় না, তবু ডিপ্লোম্যাটিকালি পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়: তুমি হিংস্র, তুমিই সন্ত্রাসের কারণ। বলি কী, অষ্টমী পুজোর ভোগ সবার আগে পৌঁছে দিন এই জড়োসড়ো, ভেতরে ভেতরে অপমানে ফুঁসতে-থাকা মানুষগুলির ঘরে। দেখবেন, মা-র চোখে ঝিকমিক করে উঠল আনন্দাশ্রু।
বাড়ির কাজের মানুষ, যাঁদের আমরা লোক-দেখানো আবেগে সহচর-সহচরী বলতে ভালবাসি ইদানীং, পুজোয় অন্তত এক দিনও যদি এঁদের সকলকে খাওয়ার টেবিলে বসিয়ে স্বহস্তে রেঁধে খাওয়ানো যায়, আমাদের দিনযাপনের ব্র্যান্ডেড, নিজস্ব আনন্দ তা হলে এক্সটেন্ডেড হয়ে একটু অন্তত ছড়িয়ে পড়বে দেবীপুজোর সামান্য সার্থকতা নিয়ে।
আপনার ননদ প্রিয়ঙ্কা ভালবাসে ওর বন্ধু সুচন্দ্রাকে। এ বার পুজোয় ওরা দু’জনে একটা ট্রিপে কোথাও বেড়াতে যাবে, মনস্থ করেছে। চাকরি পেলে একসঙ্গে থাকবেও হয়তো। দোহাই, গোটা পরিবার মিলে এ নিয়ে প্রিয়ঙ্কার প্রাণ এমন ওষ্ঠাগত করে ছাড়বেন না যে, এই পুজোই ওর জীবনের শেষ উৎসব হয়। বরং, নিজের এবং আর সকলের মন সাফ করার কাজে লেগে পড়ুন। বোঝান, এ কোনও বিকৃতি নয়, বিকল্প যৌনতা। স্বাভাবিক চোখে দেখতে শিখুন এই মেয়ে দু’টিকে। দেখবেন, পুজোর বাজনা মধুরতর হয়ে বেজে উঠল আপনাদের বাড়িতে।
আর হ্যাঁ, আপনার পরিবেশ ও প্রতিবেশের মাথায় ঝুলঝাড়ু বুলিয়ে নিন, অন্তত এক বার। যাতে এ বছরের পুজোয় মেয়েদের ওপর ফরমান জারি না করা হয়— সর্বাঙ্গ ঢাকাঢুকি দেওয়া নতুন ড্রেস কিনতে হবে, পুজোর হাতে গোনা ক’টা দিনও বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখে বেশি রাতে বাড়ি ফেরা চলবে না... নিজেকে সেই পরিচ্ছন্নতার শক্তিতে সম্পন্ন করুন, যেন দেবীর ত্রিনয়নে চোখ রেখে প্রার্থনা করতে পারেন, ধর্ষণ যে করে আর ধর্ষণ যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে!
আসলে আপনাদের নয়, আমাকে, হ্যাঁ, আমাকেই শোনাচ্ছি আমি এই কথাগুলো। জামা নয়, জুতো নয়, পুজোয় চাই নতুন ঝুলঝাড়ু। যা বুলিয়ে মনকে ঝেড়েমুছে নিতে পারি। নয়তো সকালের আগমনী গাইতে বসলে পদ্মফুল, শিউলিফুল আলোয় ধরা দেবে কেন? মা এসেই বা পা পাতবেন কোথায়? কোথায় তাঁকে ঠাঁই দেব আমরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy