বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হার দুঃখের, কিন্তু, অপ্রত্যাশিত নহে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো ছেলেখেলা নহে। বিশ্বকাপের পূর্বে ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারত একটি খেলাও জিতিতে পারে নাই। টেস্ট সিরিজেও কোনও ক্রমে সম্মান বাঁচিয়াছে। হঠাৎ সব বদলাইয়া যাইবে, এমন আশা ক্রিকেটভক্তের থাকিতে পারে, ক্রিকেটবোদ্ধার নহে। দল হিসাবেও ভারত অস্ট্রেলিয়ার তুল্য নহে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের সহিত রবীন্দ্র জাডেজার তুলনা হয় না। ভারতীয় দলে বেশ কয়েক জন ভাল খেলোয়াড় আছেন। কিন্তু, ভাল দল মানে কয়েক জন ভাল খেলোয়াড়ের সমষ্টি নহে, তাহা অপেক্ষা কিছু বেশি। সেই বাড়তিটুকু ভারতীয় দলের ছিল না। উপরন্তু, স্মরণে রাখা প্রয়োজন, গড়ের নিয়ম কথাটি আকাশ হইতে পড়ে নাই। কোনও দলই টানা জিতিয়া চলিতে পারে না। হারিতেও হয়। ভারত গ্রুপ লিগে পর পর সাতটি ম্যাচ জিতিয়াছিল। গড়ের ধর্ম মানিয়াই একটি পরাজয় ভারতীয় দলের অপেক্ষায় ছিল। দুর্ভাগ্য, যে খেলাটিতে সেই ধর্মের প্রভাব পড়িল, তাহা সেমিফাইনাল। ফের চার বৎসর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করণীয় নাই।
তবে, গোটা টুর্নামেন্ট জুড়িয়া ভারত যে দাপটের সঙ্গে খেলিয়াছে, তাহাও অনস্বীকার্য। খেলায় হার-জিত থাকিবেই। সেমিফাইনালের হারে ভারতীয় ক্রিকেটারদের কৃতিত্ব খাটো হইয়া যায় না। সেই কথা বুঝিবার ধৈর্য বা বিচক্ষণতা, দেখা যাইতেছে, ভারতীয় ক্রিকেটোন্মাদদের নাই। তাহারা ক্রিকেটভক্ত নহে, ক্রিকেটের নামে এক বিদঘুটে জাতীয়তাবাদের ব্যবসাতেই তাহাদের আগ্রহ। খেলাটি বুঝিলে একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় দলকে কুর্নিশ জানানো বিধেয় ছিল। প্রথম দলকে জয়ের জন্য, এবং দ্বিতীয় দলকে তাহার ধারাবাহিক ভাল খেলার জন্য। কিন্তু, দল হারিলেই যে কোনও প্রকারে খেলোয়াড়দের হয়রান করিতে হইবে, ইহাই ক্রিকেটোন্মাদদের মানসিকতা। আগে খেলোয়াড়দের বাড়িতে পাথর ছুড়িত। এখন অনলাইন অসভ্যতা দস্তুর হইয়াছে। এই দফায় বেয়াদবির শিকার হইয়াছেন অনুষ্কা শর্মা। তিনি বিরাট কোহলির বান্ধবী। কেন কোহলির ‘ব্যর্থতা’-র দায় তাঁহার বান্ধবীকে বহন করিতে হইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর এই জনতার নিকট আশা করা অর্থহীন। কোহলির শতরানগুলির পর কেহ অনুষ্কাকে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন বলিয়া জানা নাই। পুরুষতন্ত্রের শিকড় মনের বহু গভীরে পৌঁছাইলে তবেই পুরুষের যে কোনও ব্যর্থতার পিছনে নারীর ভূমিকার কথা মাথায় আসে।
এমন আচরণ অ-বিবেচনাপ্রসূত। ক্রিকেট দলের পরাজয়ের পর সম্মিলিত শোক প্রকাশের ভঙ্গি লইয়াও যে বিবেচনা প্রয়োজন, তাহা আর কে স্মরণে রাখিবেন? বিশেষত, আমজনতা ইহাকে বিশ্বমঞ্চে ভারতের পরাজয় ও লজ্জা হিসাবেই দেখিতেছে। ভারতে ক্রিকেট যতই গুরুত্বপূর্ণ হউক, মনে রাখা ভাল, শেষ বিচারে ইহা খেলামাত্র। তাহার সহিত ভারতের সম্মানের কোনও সম্পর্ক নাই। সবেতেই জাতীয়তাবাদের চড়া মশলা ব্যবহারের প্রবণতাটি বিপজ্জনক। দেশের সম্মানের স্বঘোষিত রক্ষকরা স্মরণে রাখুন, ভারতের মর্যাদা ঠুনকা নহে। পান হইতে সুপারি খসিলেই সেই সম্মানে আঁচড় লাগে না। রাজনীতি অথবা বাণিজ্য, যিনি যে কারণেই জাতীয়তাবাদের আড়ালটি ব্যবহার করিয়া থাকুন, সাবধান! আগুন লইয়া খেলিলে তাহার ফল ভাল হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy