Advertisement
০৪ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তাপস এখনও দিদির ‘নিজের লোক’?

তাপসকে এখনই যদি বহিষ্কার করা হয়, তা হলে তৃণমূলের সাংসদ-সংখ্যা আপাতত একটি কমবে। কিন্তু মানুষ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেই। দেবাশিস ভট্টাচার্য।তাপসকে এখনই যদি বহিষ্কার করা হয়, তা হলে তৃণমূলের সাংসদ-সংখ্যা আপাতত একটি কমবে। কিন্তু মানুষ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেই।

পুরানো সেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস পাল। মার্চ ২০০১।

পুরানো সেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস পাল। মার্চ ২০০১।

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০০:২০
Share: Save:

নিবিড় আমোদ আজ, ইতরেরা জেগেছে সমাজে।/ হাতে লাঠি, কানে জবাফুল/ মানুষেরা ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে পাথরে, কাদায়.....

মাননীয় সাংসদ তাপস পালকে না চিনেই একদিন শব্দগুলি লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আজ তারই অবিকল চিত্রনাট্য!

দৃশ্যটা মনে করুন। নীল-সাদা টি-শার্ট পরা তাপস। গলায় দুলছে গোলাপি ফুলের মালা। চারপাশে তাঁর ‘ভাইসকল’। প্রকাশ্য জমায়েতে তিনি হুঙ্কার দিচ্ছেন, “আমার ছেলেদের ঢুকিয়ে দেব। রেপ করে চলে যাবে। রেপ করে চলে যাবে।” সাংসদকে ঘিরে থাকা ভিড় সে কথা শুনে উল্লাসে ফেটে পড়েছে। হাততালি দিয়ে, শিস দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে পূর্ণ সম্মতি।

তাপস যা বলেছেন তা প্রকাশ্যে আসার পরে গত এক দিন ধরে ‘ছিঃ, স্তম্ভিত, ব্যথিত, লজ্জাজনক’ ইত্যাদি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সভ্য সমাজের সর্বস্তর থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। আরও হবে। তাপস পালের দল তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বও বলেছেন, তাঁরা তাপসের এই কীর্তি কোনও মতেই সমর্থন করেন না। স্বয়ং দলনেত্রী তাঁর সাংসদের এ হেন আচরণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত।

কিন্তু দল তো এখন শুধু দল নয়। তারা এখন শাসকের আসনে। রাজ্যের আইনরক্ষক। সংবিধানের ধারক-বাহক। সরকার, প্রশাসন, পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাই ‘পায়ের তল দিয়ে তিনজনকে পিষে মারার’ কথা জনসমক্ষে কবুল করার পরেও দলীয় বিধায়ক মনিরুল ইসলাম যেমন বুক চিতিয়ে বিরাজ করেন, বিরোধীদের বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে বলে অনুব্রত মন্ডল কার্যত ‘নায়ক’ হয়ে যান, তেমনই তাপস পাল তাঁর নিজের রিভলভার দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের গুলি করার, বঁটি দিয়ে বিরোধীদের গলার নলি কেটে দেওয়ার, ‘নিজের ছেলেদের’ দিয়ে বিরোধী পরিবারের মহিলাদের ধর্ষণ করানোর মতো সর্বনাশা হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ, প্রশাসনের কেউ তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার হিম্মত দেখাতে পারেন না!

সমস্যার শিকড়টা ঠিক এইখানে। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা রাজনীতি করবেন। রাজনৈতিক অঙ্কে চলবেন। সব ঠিক। তা বলে আইনের শাসন রাজনীতির দ্বারা এ-ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? নইলে অনুব্রত থেকে মনিরুল, তাপস পাল থেকে অরূপ চক্রবর্তী (বাঁকুড়ার এই নেতা তাঁর এলাকায় ‘বহিরাগত’দের বলিদান অর্থাৎ খুন করার নিদান দিয়েছেন) কারও কোনও হুমকি পুলিশ-প্রশাসনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না কেন? দল চাইলে রাজনৈতিকভাবে তার নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়াতেই পারে। কিন্তু প্রশাসন কেন তার কাজ করতে ইতস্তত করবে! পুলিশ কেন হাত গুটিয়ে থাকবে!

সরকারের একাধিক অফিসারের কথা নির্দিষ্টভাবে জানি, সোমবার তাপস পালের হুমকি-ভাষণ সামনে আসার পরে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে যাঁরা সিঁটিয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ ঈষৎ কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘না বুঝে এই ফোনটা ধরে ফেলেছি। এবার ফোন বন্ধ করে দেব। যাতে আর কেউ আমাকে না পায়!’

অথচ এই আইনরক্ষকদের হাত কত দীর্ঘ তার পরপর নজির সাম্প্রতিক কালে তো বড় কম নেই। ফেসবুকে অম্বিকেশ মহাপাত্রের সেই ব্যঙ্গচিত্রের কথাই ধরা যাক। সেখানে ‘দুষ্টু লোকটাকে ভ্যানিশ’ করার কথা বলা হয়েছিল। সরকার মনে করেছিল, এটা প্রচ্ছন্ন খুনের হুমকি! ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় তাঁর মুখের উপর প্রশ্ন করায় শিলাদিত্য চৌধুরীকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর জেলও হয়েছিল। কামদুনি-কাণ্ডের জলও গড়িয়েছে বহুদূর। সিপিএম নেতা গৌতম দেব বা সুজন চক্রবর্তীদের বাড়িতে পুলিশ পাঠানোর কথা না হয় ধরছি না। কারণ সেগুলি সরাসরি রাজনীতির মারপ্যাঁচ।

তা হলে প্রশাসনের কাছে সাধারণ মানুষ কী ভরসা প্রত্যাশা করবে? তৃণমূল নেতানেত্রীদের কাছে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকার, পুলিশ ও আইনরক্ষকদের কাছে মানুষ কি সেই জবাব চাইতে পারে না?

মানুষের প্রতি প্রশাসকের দায়বদ্ধতার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেন। যাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানেন তাঁরাও মানবেন, নিজের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় স্পষ্ট করতে তিনি যেমন দ্বিধাহীন, তেমনই নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার ক্ষেত্রে নির্মমভাবে সতর্ক। মমতা বিশ্বাস করেন, এমন কোনও পরিস্থিতি আসতেই পারে, যেখানে ‘পারসেপশন’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ধারণাকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। আইনের খুঁটিনাটি বিচার করে সময় ব্যয় করা সেখানে অনুচিত। সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াটাই তখন জরুরি।

ঠিক যেমনটি তিনি করেছিলেন বীরভূমের লাভপুরে সালিশি সভায় একটি মেয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ পঞ্চায়েত প্রধানের জারি করা ‘ফুর্তি করে নেওয়ার’ ফরমান জানার পরে। বীরভূমের পুলিশ আদালতে গিয়ে ধৃতদের হেফাজতে নিতে যথেষ্ট তৎপর ছিল না। তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। উত্তরবঙ্গ সফরকালীন খবরটি শোনেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর দল ও সরকারের কেউ কেউ আইনি সংস্থানের প্রশ্ন তুলে পুলিশের কাজকে সার্টিফিকেট দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে তিলমাত্র দেরি করেননি। দলের জনৈক নেতাকে ফোন করে তিনি বলেছিলেন, “আমরা রাজনীতি করি। কিছু ক্ষেত্রে আইনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, মানুষ কী ভাবে নেবে। তাই পুলিশ আইনের কোন ধারায় কী করেছে, সে-সব পরে দেখা যাবে। আপাতত আমি পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেব।” আধঘন্টার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বীরভূমের এসপি বদলি হয়ে যান।

তবু মমতার দলে, তাঁর চারপাশে এমন কিছু ঘটনা প্রায় নিত্য ঘটে চলেছে যা তাঁর প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ভাবনার সঙ্গে বেমানান। কেন? দল এবং সরকারের ভবিষ্যতের জন্য এর উত্তর খোঁজার মতো আত্মসমীক্ষা বোধহয় তৃণমূলের পক্ষে জরুরি হয়ে উঠেছে। সেই সমীক্ষা যদি নির্মোহ হতে পারে, তা হলে মনিরুল,অনুব্রত, তাপস পালেদের প্রতি দলের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে বাধ্য।

তাপসের কথাই ধরা যাক। তাপস কী বলেছেন, কতদূর বলেছেন, কতটা অশ্লীল ও আইনভঙ্গকারী হুমকি ছড়িয়ে দিয়েছেন সেটা আজ তো কারও অজানা নয়। কিন্তু দল কী করল? সোমবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে নিন্দা করে বলল, মমতা অত্যন্ত মর্মাহত ও ক্রুদ্ধ। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাপসের জবাব চাওয়া হয়েছে।

কেন ৪৮ ঘন্টা? বক্তৃতার ভিডিও দেখার পরে আরও কী জানার থাকতে পারে? তাপস ফ্যাসাদে পড়ে ‘রেপ’কে ‘রেড’ (Raid) বলে চালানোর অপচেষ্টা করার পরেও কি বুঝতে বাকি থাকে কিছু! তার পরেও বা কী হল? মঙ্গলবার দলের সর্বভারতীয়

সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় তাপসের লেখা ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চাওয়ার একটি চিঠি বিলি করে দাবি করলেন, এই সাংসদ দলের সর্বস্তরে লিখিতভাবে তাঁর ভুল স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন: তাতে জনগণের কী আসে যায়? তাপসকে সর্বসমক্ষে হাজির করে ক্ষমা চাওয়ানোর বিবেকবোধটুকু কি দলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না? যদি কেউ বলেন, সাংসদকে আড়াল করে রাখতেই দল এই কৌশল নিল, তা হলে সেটা হয়তো খুব ভুল বলা হবে না।

আজ তৃণমুলের সাংসদ, বিধায়ক ও নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসবেন মমতা। এই বৈঠক অবশ্য পূর্বনির্ধারিত। সম্ভাবনা বলে, তাপস পাল বৈঠকে যাবেন। তাঁকে ভর্ৎসনা করা হবে। তিনি ক্ষমা চেয়ে কিছু বলবেন। ধরে নেওয়া যায়, দল তাঁকে ‘ক্ষমা’ করে সতর্ক করে দেবে।

কিন্তু দিল মাঙ্গে মোর! মমতা যে ধারণায় বিশ্বাসী, মহিলাদের সম্মান রক্ষা সম্পর্কে তিনি যে-সব ভাবনার কথা নিয়ত বলেন, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তাঁর যে মনোভাব তিনি সর্বদা ব্যক্ত করে থাকেন, তাতে তাপস পাল নিছক ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে গেলে তা দুর্ভাগ্যের হবে! তাপসের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ৩৪টি লোকসভা আসনে সদ্য জিতে এসেছেন মমতা। তাপস পাল তাঁদের একজন। তাঁর পরপর দুটি সভার ভাষণ থেকে দলের ভাবমূর্তি প্রকাশ্যে কলঙ্কিত করার জন্য তাপসকে এখনই যদি বহিষ্কার করা হয়, তা হলে তৃণমূলের সাংসদ-সংখ্যা আপাতত একটি কমবে। কিন্তু মানুষ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেই। আগামী দিনে সেই জনসমর্থনই হবে তৃণমূলের পাথেয়।

আর তা না হলে?

‘ক্ষমা’ পেয়ে তাপস সাংসদ থাকবেন। যেমন স্বয়ং মমতার সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করেও ক্ষমা চেয়ে ‘খালাস’ হয়ে গিয়েছেন সিপিএমের বিধায়ক আনিসুর রহমান! আবার, অন্য কোথাও, অন্য কোনও দিন এই রকম দাদাদের অন্য কোনও কীর্তি দেখার অপেক্ষায় থাকব আমরা।

শুধু মমতার কাছে একটি জিজ্ঞাসা, ‘লোক ঢুকিয়ে রেপ করে দেওয়ার’ হুমকিতে বলীয়ান সাংসদ তাপস পালকে নিজের দলের লোক বলে পরিচয় দিতে কেমন লাগবে আপনার? ঘৃণা হবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE