Advertisement
E-Paper

দুনিয়ার হাটে হাঁড়িটি যেন না ফাটে

উন্নয়নের ঠাকুরমার ঝুলিতে দেশবাসী ভোট ভরে দিয়েছেন। তার ভিতরের বেড়ালের চেহারাটা পাঁচ জন দেখে ফেলবে, সেই ভয়েই প্রিয়া পিল্লাইকে বিমান থেকে নামিয়ে আনা হল?কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে একটা চমত্‌কার বিজ্ঞাপন দেখাত। মহিলাদের বিরুদ্ধে বিবিধ অত্যাচার বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ ‘বেল বাজাও’-এর বিজ্ঞাপন। এক বাড়ি থেকে এক মহিলাকণ্ঠের আর্ত চিত্‌কার শুনে খানিক ইতস্তত করার পর কলিং বেল বাজাতেন এক নিরীহ প্রতিবেশী। বাইরের লোকের সেটুকু উপস্থিতিতেই মারমুখী স্বামী অন্তত সাময়িক ভাবে থমকে যেতেন।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
পাছে লোকে কিছু শোনে। প্রিয়া পিল্লাই। দিল্লি আদালতের রায়ের পরে। ছবি: পিটিআই।

পাছে লোকে কিছু শোনে। প্রিয়া পিল্লাই। দিল্লি আদালতের রায়ের পরে। ছবি: পিটিআই।

কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে একটা চমত্‌কার বিজ্ঞাপন দেখাত। মহিলাদের বিরুদ্ধে বিবিধ অত্যাচার বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ ‘বেল বাজাও’-এর বিজ্ঞাপন। এক বাড়ি থেকে এক মহিলাকণ্ঠের আর্ত চিত্‌কার শুনে খানিক ইতস্তত করার পর কলিং বেল বাজাতেন এক নিরীহ প্রতিবেশী। বাইরের লোকের সেটুকু উপস্থিতিতেই মারমুখী স্বামী অন্তত সাময়িক ভাবে থমকে যেতেন। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে যে মারাত্মক অন্যায় বুক ফুলিয়ে করে ফেলতে পারেন পরিবারের পুরুষসিংহটি, এক জন বহিরাগতের দৃষ্টি তাঁকে লজ্জায় ফেলে দেয়। নিজের অন্যায়টা অন্যের চোখে ধরা পড়ে যাচ্ছে, এই চক্ষুলজ্জার বাড়া বালাই আর নেই।

লোকে শুনলে বলবে কী

নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে দেখে সেই বিজ্ঞাপনের পুরুষসিংহটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে অবশ্য হাজার একটা কারণেই মনে পড়া সম্ভব, কিন্তু আপাতত চক্ষুলজ্জার প্রসঙ্গে আশ্চর্য রকম মিল পাচ্ছি। জানুয়ারির গোড়ায় গ্রিনপিস নামক এক অসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি প্রিয়া পিল্লাইকে ব্রিটেনগামী বিমানের আসন থেকে নামিয়ে আনল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। প্রিয়া পরিবেশকর্মী। ব্রিটেন যাচ্ছিলেন সেখানকার পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে। ব্রিটেনের এক সংস্থাকে সুবিধা করে দিতে মোদী সরকার মধ্যপ্রদেশে জনজাতিভুক্ত মানুষের অধিকার কী ভাবে ছিনতাই করছে, সে বিষয়ে বলতেন প্রিয়া। তাঁর কথা শুনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্যবসায়িক সংস্থার স্বার্থে ঘা দিয়ে জনজাতির অধিকার রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ত বলে মনে হয় না। কিন্তু, কথা হত নিশ্চিত। কিছু লেখালিখি হত। যে উন্নয়নের ঠাকুরমার ঝুলিতে দেশবাসী ভোট ভরে দিয়েছেন, তার ভিতরের বেড়ালটার চেহারা কী, দুনিয়ার পাঁচ জন জানত। মনে হয় সে লোকলজ্জা ঠেকাতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রিয়া পিল্লাইকে নামিয়ে আনল বিমান থেকে। দিল্লি হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানাল, প্রিয়া বিদেশে গিয়ে যে সব কথা বলতেন, তাতে ভারতের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হত। তাঁর আচরণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী। আদালতে এ সব বলার আগেই অবশ্য প্রিয়ার পাসপোর্টে ছাপ মেরে দেওয়া হয়: ‘অফলোডেড’। মারাত্মক সন্ত্রাসবাদী বা দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতীদের ক্ষেত্রে যা যা করণীয়, প্রিয়া পিল্লাইয়ের ক্ষেত্রে তার কিছুই বাদ রাখেনি কেন্দ্রীয় সরকার।

দিল্লি হাইকোর্ট সরকারের নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে। দেওয়ারই ছিল। তবে সেটা কিন্তু এই কুনাট্যের মোক্ষম মোচড় নয়। প্রিয়াকে আটকাতে বেপরোয়া ব্যস্ততার পিছনের কারণটাই আসল। কারণ সেই লোকলজ্জা। বিজ্ঞাপনের স্বামীটির স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে বাধত না, অরণ্যনির্ভর জনজাতির যত্‌সামান্য অধিকারে থাবা বসাতেও বাধে না রাজনীতিকদের। দেশের প্রত্যেক চার জন জনজাতিভু্ক্ত মানুষের এক জনকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে উন্নয়নের রাস্তা সাফ করে দিতে, জনজাতিভুক্ত মানুষের সঙ্গে দেশের অন্যান্যদের মানব উন্নয়ন সূচকে ফারাক ৩০ শতাংশেরও বেশি, ৪০ শতাংশ জনজাতিভুক্ত মানুষ তীব্র অপুষ্টিতে ভোগেন এই বাস্তবগুলো তৈরি করতে কর্তাদের লজ্জা হয় না। লজ্জা শুধু কথাগুলো বিশ্বজনের সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়। ঠিক যেমন বউ পেটানোর দৃশ্যটা পড়শি দেখে ফেললে ভারী লজ্জা করে, তেমন।

লজ্জা যে শুধু নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীরই করে, তা বললে ডাহা মিথ্যে বলা হবে। দুনিয়া জুড়ে অনেকেরই এমন চক্ষুলজ্জা আছে। উত্তর কোরিয়ায় যেমন দেশ বন্যায় ভেসে গেলেও সে খবর বাইরে আসে না, মানুষ না খেয়ে মরলেও নয়। চিনে গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড-এর দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ঠিক কত ছিল, প্রায় ছয় দশক পেরিয়েও জানার উপায় নেই। রাষ্ট্র এক সন্তান নীতি গ্রহণের পর যাঁদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তান হল, সেই শিশুগুলির কী হল, পার্টি সেই খবর চেপে রেখেছে প্রাণপণ। মায়ানমারের সামরিক শাসকরা সু চি-কে গৃহবন্দি করে রাখতেন।

তাড়নাটি যে চক্ষুলজ্জারই, তার হাতেগরম প্রমাণ আছে। চিনের মহামহিম কমিউনিস্ট পার্টি স্বদেশের কয়েক কোটি লোককে খামখা জেলে পুরে দিল, নাকি না খেতে দিয়ে মেরেই ফেলল, সে খবর যদি দুনিয়ায় রাষ্ট্রও হয়ে যায়, চিনের তাতে লবডঙ্কা। নিজের নাক কেটে চিনকে শাসন করতে আসবে, এমন সাহস এ ধরাধামে কোনও দেশের নেই, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও না। এ তো আর পাকে পড়া রাশিয়া নয় যে ব্রিটেন নামক দ্বীপরাষ্ট্রটিও ধমকে দেবে। বিশ্বায়নের খেলায় চিন এখন অসীম শক্তিধর। তবুও চিনের পার্টি ঘোরতর সতর্ক, খবর যেন বাইরে না যায়। ভারতের অবস্থাও নেহাত খারাপ নয়। একে এত বড় বাজার, তায় দক্ষিণ এশিয়ায় এমন মোক্ষম অবস্থান ভারতের সঙ্গে কেউ সেধে সম্পর্ক খারাপ করবে না, তাও আবার জনজাতির অধিকারের মতো ‘তুচ্ছ’ কারণে। তবু, দুনিয়ার চোখে ছোট হয়ে যেতে কারও মন চায় না।

অতএব, পিয়ংইয়াং থেকে বেজিং, দামাস্কাস থেকে মস্কো, হাভানা থেকে তাসকন্দ, সর্বত্রই শাসকদের মূল মাথাব্যথা, দেশের খবর যাতে বিদেশে পৌঁছে না যায়। আমাদের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীও বিলক্ষণ জানেন, দেশের মানুষের একটা বড় অংশের সঙ্গে তিনি বা তাঁরা যা করছেন সেটাকে ন্যায্য বা নৈতিক বলার উপায় নেই। অনুমান, নৈতিকতার সিলমোহর পাওয়ার জন্য তাঁরা তেমন ব্যস্তও নন। কিন্তু, পড়শিরা সেই অনৈতিকতার আঁচ পেলে তাঁদের লজ্জা হয়। লজ্জা ঠেকানোর জন্য কাউকে বিমান থেকে নামিয়ে আনতে হলে তা-ই সই। বিদেশের লোকের চোখে সম্মানহানি কি কম কথা?

ঘরে-বাইরে

ঘরে-বাইরের এই খেলাটি আজকের নয়। বস্তুত, স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম সেরা হাতিয়ার হল দেশের ভিতরকার খবর দুনিয়ার সামনে ফাঁস করে দেওয়া। দাদাভাই নওরোজিরা ইংল্যান্ডে দাঁড়িয়ে সে দেশের মানুষকে জানাতেন, তাঁদের সুসভ্য প্রতিনিধিরা কী দারুণ শাসন করছে ভারতীয় উপনিবেশে। এখনও প্রায় জীবন বাজি রেখে উত্তর কোরিয়া থেকে চিনের সীমান্ত পেরিয়ে জাপানে ভিডিয়ো সিডি পৌঁছে দেন দুঃসাহসীরা, বাশার আল-আসাদের স্বৈরশাসনের খবর পৌঁছে যায় সংবাদমাধ্যমে। যাঁরা পাঠান, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, এখনই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে কেউ জঙ্গিবিমান পাঠাবে না, এখনই লাঘব হবে না প্রাত্যহিক যন্ত্রণা। প্রিয়া পিল্লাইও জানতেন, ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তাঁর ভাষণ শেষ হওয়ামাত্রই সংযত করা হবে না ব্রিটিশ সংস্থাটিকে। তবুও প্রত্যেকেই চান দেশের সীমান্ত পেরিয়ে, শাসকের নাগাল পেরিয়ে তৈরি হোক বৃহত্তর জনসমর্থন। আলোচনা হোক অপশাসন নিয়ে, খানিক নিন্দে হোক। প্রিয়া পিল্লাইরা যেমন চান, আর কিছু না হোক, আগামী বছর যে মানব উন্নয়ন রিপোর্টগুলো তৈরি হবে, তাতে যেন ভারতের অরণ্যনির্ভর জনজাতিদের সামূহিক বঞ্চনার বাস্তবটারও প্রতিফলন ঘটে। লজ্জা পেয়েও যদি একটু থমকে দাঁড়ায় কর্পোরেট উন্নয়নের সরকারি রথ।

রাষ্ট্রের কর্তাদের পক্ষে এহেন প্রচার অস্বস্তিকর। যেখানে তেমন ঝুটঝামেলা নেই, সেখানে দিব্য পিটিয়ে শায়েস্তা করে দেওয়া চলে। বিনা বিচারে জেল, এমনকী ফাঁসি এমন কিছু বিরল ঘটনা নয়। সমস্যায় পড়েন নরেন্দ্র মোদীরা। অন্তরাত্মা যা-ই চাক, গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই তাঁদের। অতএব, প্রিয়া পিল্লাইদের বিমান থেকে নামিয়ে আনতে অথবা ইন্ডিয়াজ ডটার-এর সম্প্রচার আটকাতে জাতীয়তাবাদের মোক্ষম অজুহাতটি প্রয়োজন হয় তাঁদের। তবে, এখানেও নরেন্দ্রভাই একা নন। যেমন, উজবেকিস্তানেও দেশের খবর বাইরে প্রকাশ করলে তা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। শাস্তির পরিমাণও ভারতের তুলনায় কড়া। এমনিতেও, জাতীয়তাবাদের মার নেই। সঙ্ঘ পরিবার থেকে সর্বভারতীয় খবরের চ্যানেলের পঁয়ত্রিশ হাজার ডেসিবেলে চিত্‌কার করা অ্যাঙ্কর, সবাই সমান শক্তিতে সরকারের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন এই একটি কারণের জন্য। দেশাত্মবোধের প্রবল সুনামিতে ঢাকা পড়ে যায় বেয়াড়া প্রশ্নগুলো। যেমন, ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সংস্থার স্বার্থ দেশের জনজাতিগুলোর স্বার্থের চেয়ে বেশি জাতীয় কি না, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর সর্বজনে ঠিক কাদের ঠাঁই হয়েছে, এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আর দরকার পড়ে না।

নতুন খেলা

কিন্তু, সে প্রসঙ্গ থাক। উত্তর কোরিয়ার কিম জং-আন থেকে ভারতের নরেন্দ্র মোদী, মানে যাঁর কিছুমাত্র অজুহাতের প্রয়োজন নেই থেকে যাঁর জম্পেশ জনসমর্থিত অজুহাতের দরকার খুব, তাঁদের প্রত্যেকেই যে একটা বেমক্কা বিপাকে পড়েছেন, সে কথা বলি। খবর বাইরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আর সশরীরে বাইরে যেতে হয় না কাউকে। ইন্টারনেটই যথেষ্ট। মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত কোনও প্রান্তে বসেও প্রিয়া পিল্লাই ব্রিটেনের এমপিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন বিলক্ষণ। রাষ্ট্রের নজরদারিকে কাঁচকলা দেখিয়ে চিনের রাস্তায় প্রতিবাদের ছবি মুহূর্তে আপলোড করে দেওয়া যায় ইউটিউবে। চিনের উদাহরণটা বেশ মজার। সে দেশে সরকারি কড়াকড়ি বহু স্বৈরতন্ত্রেরই ঘোর পছন্দের। ইরানের মতো দেশ প্রকাশ্যেই জানিয়েছে, তারা চিনের মডেল অনুসরণ করতে চায়। আবার, কী ভাবে সরকারি নজরদারি এড়িয়ে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় পৌঁছে যেতে হয়, সেটাও গোটা দুনিয়ার প্রতিবাদী জনতার কাছে মডেল। আপাতত যে দ্বিতীয় দলই খেলায় এগিয়ে আছে, অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। চিনের ভিতরকার এত বিস্তারিত খবর ১৯৪৯ সালের পর গোটা দুনিয়া আর কখনও পায়নি।

আর, রাষ্ট্রের পক্ষে এই নতুন খেলার সবচেয়ে মারাত্মক দিক হল, কোনও এক জন বা কয়েক জনকে বেছে নিয়ে নজর রাখার সুযোগ ক্রমেই কমছে। এখন আর নেতা হওয়ার প্রয়োজন নেই, এমনকী পাঁচ জনের কাছে পরিচিত হওয়াও বাহুল্যমাত্র। কে কোন খবর কোথায় পৌঁছে দেবে, তা অনুমানের বাইরে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি করেও যে বিশেষ লাভ নেই, টের পাওয়া গেছে। বলাই যায়, একুশ শতকের প্রযুক্তি এসে বিশ শতকের রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদী স্বভাবতই আরএসএস-এর পাঠশালায় এই নতুন খেলাটি শেখার সুযোগ পাননি। চিন্তায় পড়া স্বাভাবিক।

পড়শির নজর এড়িয়ে বউ পেটানোর নতুন পন্থা আবিষ্কার করতে না পারলে তো সত্যিই ভারী মুশকিল।

post editorial amitava gupta priya pillai anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy