Advertisement
E-Paper

‘দোষীরা কেন শাস্তি পায় না বলো তো’

এ প্রশ্ন কামদুনির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। গত বছর ৭ জুনের ধর্ষণের ঘটনা যাদের এক ধাক্কায় বড় করে তুলেছে, আন্দোলন শিখিয়েছে, আবার জীবনকে সন্দেহ করতেও শিখিয়েছে। চেনা দিনযাপনের ছকটাই বদলে গিয়েছে তাদের। বোলান গঙ্গোপাধ্যায়।নিজেদের কী করে বাঁচাব, জানি না দশ বছরের একটা মেয়ের মুখে এই কথা শুনলে প্রথমটা মনে হয়, পাকামি, তার পর ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এত কম বয়সেই নগ্ন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের, অতএব বড়দের কথাই যে তাদের কথা হয়ে উঠবে, এ আর আশ্চর্য কী!

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০০:০০

নিজেদের কী করে বাঁচাব, জানি না দশ বছরের একটা মেয়ের মুখে এই কথা শুনলে প্রথমটা মনে হয়, পাকামি, তার পর ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এত কম বয়সেই নগ্ন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের, অতএব বড়দের কথাই যে তাদের কথা হয়ে উঠবে, এ আর আশ্চর্য কী! এই মেয়েটি কামদুনি গ্রামের মেয়ে। যে কামদুনিতে গত বছর ৭ জুন কলেজ থেকে ফেরার পথে নৃশংস ভাবে ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছিল এক তরুণী। গত এক বছরে সেই মৃত্যুকে ঘিরে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কামদুনি গ্রাম। সেই প্রতিবাদ থামানোর চেষ্টাও হয়েছে নানা ভাবে। আর তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। জীবনের পদে পদে ঢুকে গিয়েছে ভয়। ভিতরে ভিতরে বদলে গিয়েছে দিনযাপনের নকশা।

সম্প্রতি কামদুনির কিশোরকিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে তা-ই মনে হল। গত এক বছর ধরে পাল্টে যাচ্ছে তাদের বন্ধুত্ব, তাদের খেলা, তাদের আলোচনার বিষয়। এমনকী ক্লাস ফোরের মেয়েরাও সচেতন হয়ে উঠছে ধর্ষণ আর খুন সম্পর্কে। টিভিতে নারী নির্যাতনের নানা ছবি এর আগে অনেক দেখলেও একেবারে ঘরের পাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাদের এক ধাক্কায় অনেকটা বড় করে দিয়েছে। এই শিশুকিশোরদের অনেকেই বলল, এই ঘটনা আর তাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ, গোটা গ্রামের দৈনন্দিন জীবনকে একদম পাল্টে দিয়েছে। আমি জানতে চাই ‘কেমন করে?’ ওরা বলে ওঠে, ‘আগে গরমের ছুটিতে দুপুরবেলা আমরা খেলতাম, এখন আর বেরোতে দেয় না। বিকেলেও খেলতে দেয় না। সন্ধে হবার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে হয়।’ মেয়েদের তো বটেই, ছেলেদেরও বাড়ির বাইরে থাকা নিরাপদ নয় বলে মনে করেন অভিভাবকরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বাচ্চাদের কথা একেবারেই ঠিক। তারা খুব ভয় পেয়ে আছে। জীবনের প্রতি স্বাভাবিক বিশ্বাসও ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে এই শিশুরা।

প্রথম যখন আন্দোলন শুরু হয়েছিল, প্রায় সব গ্রামবাসীই তাতে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসতে থাকে, অপরাধীদের ধরতে অনেক দেরি হয় আর তার পর অন্যান্য অনেক আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনটাও ঝিমিয়ে পড়ে। তা ছাড়া ধর্ষিতার আপনজনেদের ক্ষতিপূরণের চাকরি নিয়ে গ্রাম থেকে চলে যাওয়াটা আন্দোলনে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। শুভজিত্‌, বিতনু, বেলা, শান্তি, প্রিয়ঙ্কা, সকলেই আক্ষেপ করে, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছে। ধর্ষিতার বাড়ির লোকদের চাকরি নেওয়াটা তাদের পছন্দ হয়নি। ‘ওদের জন্যই তো আমাদের গ্রামটা এই রকম হয়ে গেল।’ আমি যখন বলি, ‘কিন্তু ওদেরও তো চাকরি দরকার ছিল’, প্রিয়ঙ্কা বলে, ‘ছিল, কিন্তু ওরা চাকরি নিল বলেই তো কেসটা আর উঠছে না। দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে না।’ অন্যরা ওকে সমর্থন করে। শান্তি জানায়, ‘আন্দোলনটা ঝিমিয়ে পড়ায় অনেকে আবার বলে, ‘কী রে! তোরা যে চুপ করে গেলি?’ আমি কিছু নিইনি। কিন্তু ওরা (ধর্ষিতার আত্মীয়রা) নেওয়াতে যেন আমারই মাথা হেঁট হয়ে গেল।’

এখানেই শেষ নয়, প্রতিবাদীরা হুমকি থেকে শুরু করে মিথ্যা মামলা পর্যন্ত সব রকম নির্যাতন সহ্য করছেন। মামলার নিষ্পত্তিই বা হচ্ছে কই? ক্রমশ তা পিছিয়েই যাচ্ছে। অনেকেরই মনে হচ্ছে, লড়াইটা অসম হয়ে যাচ্ছে এবং এই অসম লড়াইয়ে জেতা হয়তো অসম্ভব। আস্তে আস্তে মানুষের যোগদান কমে যাচ্ছে। যাঁরা প্রতিবাদী শিবিরে রয়েছেন তাঁদের খুব সহজেই চিনে নেওয়া যাচ্ছে, ফলে তাঁদের সমস্যা বাড়ছে।

অন্য দিকে, আগে যাঁরা প্রতিবাদী ছিলেন তাঁরা অনেকেই শিবির বদলেছেন। গত বছর যে সব মানুষ একসঙ্গে, একজোট হয়ে লড়াই শুরু করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একটা ভাগ হয়ে গিয়েছে। কাল অবধি যে শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল, আজ সে হিতৈষী আর আছে কিনা, সেই সন্দেহ দানা বাঁধছে গ্রামবাসীদের মধ্যে। দুই ছেলেমেয়ের মা ফুলমণি বলে, ‘কী জানি, কার মনে কী আছে?’ কে যে বন্ধু আর কে যে শত্রু, সবই কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তাই আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তাঁরা। বরং নিজেদের ছেলেমেয়েদের কী করে আগলে রাখা যাবে সেই চিন্তায় সবাই ব্যস্ত।

গত কাল যারা প্রতিবেশী ছিল, এক সঙ্গে সুখদুঃখের একটা বড় সংসার ছিল, আজ কেন হঠাত্‌ সে সব সম্পর্ক গুলিয়ে যাচ্ছে? যাচ্ছে, কারণ গ্রামের মধ্যে অবাধ মেলামেশায় বাধা এসে গেছে যে! বাচ্চাদের জগতেও তার ছায়া। ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা বলে, ‘ধরো, সুভাষ আর আমি বন্ধু। কিন্তু সুভাষের বাবা প্রতিবাদীদের সঙ্গে নেই। তাই আমি আর সুভাষও কথা বলি না। আমার বাবা তো প্রতিবাদী।’ কলেজপড়ুয়া শান্তি বলে: ‘আমাদের যারা বলে, জব কার্ডে কাজ পাবে না, তাদের সঙ্গে কী করে বন্ধুত্ব হবে?’ ভাগাভাগির এই রকম কথা সিঙ্গুরে শুনেছি, নন্দীগ্রামে শুনেছি। এখন কামদুনিতেও শুনছি।

কিছুই কি হয়নি? গত বছর এই সময়ে চার পাশের মদের ভাটি ভেঙেছিল গ্রামবাসীরা। সেই ভাটি আর তৈরি হয়নি। কিন্তু মদ্যপান বেড়েছে, এমনকী ছোটয় বড়য় মিলে অনেকেই বলেছেন, পুলিশ-ক্যাম্পের পুলিশরাও ক্লাবঘরে বসে অন্যদের সঙ্গে মদ্যপান করে। কলেজছাত্রী শান্তি বা ক্লাস সেভেনের অণিমা মনে করে যে ‘রাস্তার ধারের ছেলেদের টিটকিরি দেওয়াও কমেছে’, তবে রাস্তা দিয়ে ফিরতে এখনও বড্ড ভয় করে। দল বেঁধে ফেরার চেষ্টা করে। এই ভয় কাটাতে রাস্তার আলো খুব জরুরি বলে মনে হয় ওদের, আর জরুরি যানবাহন। রাস্তার আলো, যানবাহনের সুবিধা, পুলিশ ফাঁড়ির দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নামেন। এক বছরের মধ্যে এই ন্যূনতম নাগরিক দাবিগুলোর অনেক কিছুই পূরণ করা হয়নি।

কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয়ের যেটা, তা হল হিংসা। হিংস্রতা। বিদ্বেষ। ছেলেমেয়েরা বলল অনেকেই, এত মারামারি এর আগে কখনও দেখেনি ওরা। এত অন্যায়ও না। শুভজিত্‌ বলে ‘আমাদের এখানে অন্যকে ভোট দিলে জরিমানা হয়, জানো? এটা অন্যায় না?’ অন্যরাও শুভজিত্‌কে সমর্থন করে। বাচ্চাদের কথা থেকে জানতে পারি, লোকসভা ভোটের ফল বের হওয়ার পর জানা গেছে যে, ওই অঞ্চলে শাসক দল সব ভোট পায়নি, কিছু ভোট সিপিএম এবং বিজেপি পেয়েছে। তখন কারা এই ভোট দিয়েছে, সেই সন্দেহে ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’য় শামিল হওয়া মানুষদের ওপর চড়াও হয় শাসক দলের কর্মীরা। এবং কারও কারও ক্ষেত্রে সালিশি সভা বসিয়ে নিজেরাই জরিমানা ধার্য করে। পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছেন সত্যরঞ্জন। তাঁর বাড়ির টিউবওয়েলটা খুলে নিয়ে চলে গেছে দুষ্কৃতীরা। ‘কেন দিলেন?’ তিনি জবাব দেন, ‘না দিলে ঘরছাড়া করত।’

বাচ্চারা আমাকে প্রশ্ন করে, ‘কেন দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে না বলো তো?’ আমার কোনও উত্তর ছিল না। ‘এক দিন পাবে’, এ কথাও বলতে পারিনি। আমি তো জানি, কত দোষীরই শাস্তি হয় না। বাচ্চাদের কথাবার্তায়, চলনে-ধরনে বড়দের ছায়া দেখতে পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেছে। বড়দের আর ছোটদের জগতের মাঝের দেওয়ালটা যদি এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়, তার ফল ভাল হয় না। কিন্তু অহোরাত্র যাদের বড়দের আলোচনা আর বিতণ্ডার মধ্যে সময় কাটাতে হয়, তাদের এ ছাড়া উপায় কী!

চোখের সামনে এই সব দেখতে দেখতে যে শিশু বালক হয়ে উঠছে এবং যে তরুণ পূর্ণবয়স্ক, তাদের চিন্তার ধারা, মানসিকতা যে খুব সুস্থ থাকবে না এ কথা বলে দেওয়ার দরকার হয় না। তারা আর পাঁচ জনের মতো বাইরের জগত্‌কে দেখবে না। তাদের দেখার মধ্যে বঞ্চনাবোধ আর সন্দেহ মিশে থাকবে। তবে এরই মধ্যে একটা কথা খেয়াল করলাম। অনেক ক্ষেত্রেই জোরজুলুম আর হিংসার ভয়াবহ রূপ পরবর্তী কালে বন্দুকধারীর জন্ম দেয়। কামদুনির ছেলেমেয়েরা কিন্তু এখনও তেমনটা ভাবে না। যত বার যাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কী করলে এ সব বন্ধ হবে’, সব বাচ্চারাই আলাদা আলাদা করে বলেছে ‘আন্দোলন করব’।

মনে হয়, এক দিন চোখের সামনে সমস্ত গ্রামবাসী মিলে একজোট হয়ে পথে নেমেছিলেন, শহরের লোকেরা এসে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা ওদের মনে ‘আন্দোলন’ সম্পর্কে একটা সদর্থক চিন্তার জন্ম দিয়েছে। বিতনুর ভাষায় বললে: ‘একসাথে হতে হবে।’ ওইটুকুই হয়তো ভরসা।

(নাম পরিবর্তিত)

post editorial bolan gangopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy