E-Paper

সংস্কার হোক ভিতর থেকে

“ইসলাম যে নারীদের অধিকার দিয়েছে, তা পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হলে বহু মানুষের বদ্ধমূল ভুল ধারণা ভেঙে যেত,” লিখেছিলেন ললিতা আইয়ার। এই পর্যবেক্ষণ ঠিক। কিন্তু কেন ভারতে মুসলিমদের পারিবারিক আইন মেয়েদের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না?

আফরোজা খাতুন

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৪

সুপ্রিম কোর্টে বিচার চেয়েছেন কয়েকজন মহিলা, যাঁদের বিবাহ ছিন্ন হয়েছে তালাক-ই-হাসান দ্বারা। দুই ঋতুর মধ্যবর্তী কালেক্রমান্বয়ে তিন মাসে বিনা সহবাসে তিন বার তালাক দিয়ে ত্যাগ করাকে বলে তালাক-ই-হাসান। এই তালাকনামা বা পরিত্যাগপত্র নিয়ে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের। আবেদনকারীদের অন্যতম বেনজির হীনাকে তাঁর স্বামী তালাক দিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে, তালাকের নোটিসে স্বামী সই করেননি। স্বামীর স্বাক্ষর না থাকলে, তালাক হয়েছে প্রমাণ হবে না। ভবিষ্যতে বেনজির কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না, অথচ তাঁর ‘প্রাক্তন’ স্বামী নির্বিঘ্নে আর একটা বিয়ে করেছেন। এ ছাড়াও বেনজিরের অভিযোগ, ওই তালাকনামা দিয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে, পাসপোর্ট করাতে পারছেন না।

“ইসলাম যে নারীদের অধিকার দিয়েছে, তা পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হলে বহু মানুষের বদ্ধমূল ভুল ধারণা ভেঙে যেত,” লিখেছিলেন ললিতা আইয়ার। এই পর্যবেক্ষণ ঠিক। কিন্তু কেন ভারতে মুসলিমদের পারিবারিক আইন মেয়েদের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না? তালাক-ই-হাসান বৈধ কি না, তা হয়তো সুপ্রিম কোর্ট বিচার করবে। কিন্তু এ বিষয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মসমালোচনা জরুরি। সমাজে তালাকের প্রয়োগ হচ্ছে ক্ষমতাবানদের সুবিধামতো। কোরানের সূরা নিসা-য় বলা আছে, “আর যদি দু’জনের (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করো তবে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার থেকে এক জন এবং ওর (স্ত্রীর) পরিবার থেকে এক জন সালিশ নিযুক্ত করবে।” বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই সালিশ নিযুক্ত হয় না, পুরুষ একতরফা তালাক দেয়। ১৯৩২-এ অসমাপ্ত রচনা ‘নারীর অধিকার’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া লেখেন, “আমাদের ধর্ম্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্রপাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?”

একতরফা তালাক গ্রাহ্য হবে কি না, নির্ভর করে এলাকার মুরুব্বিদের উপর। কোরানে, হাদিসে যা-ই লেখা থাক না কেন, সারা দেশে কিন্তু একই নিয়ম চালু নেই। যদি থাকত, তবে মুর্শিদাবাদের সাবিনাকে পণ পরিশোধ করতে না পারার জন্য তালাক পেতে হত না। পণ দেওয়া-নেওয়া ইসলাম মতে হারাম (নিষিদ্ধ)। মুরুব্বিরা বলেছেন, পণ দিতে না পারায় তালাক দেওয়া অন্যায়, অধর্ম। কিন্তু তালাক যখন দিয়েছে তখন মানতেই হবে। ওর (স্বামীর) কৃতকর্মের জন্য পরকালে শাস্তি পাবে। পরকালে জবাবদিহির ভরসায় ইহকালে ছাড় পায় এমন অনেক পুরুষ। কিন্তু ইহকালে শাস্তি মেনে নিতে হয় অন্যায় ভাবে তালাক পাওয়া স্ত্রীকে। নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মানুষদের হাতে তালাকের নথিও সব সময়ে থাকে না।

এ দেশে মুসলিম পারিবারিক আইন-বিধি নথিবদ্ধ (কোডিফায়েড) না হওয়ায় বিপদে পড়ছেন অনেক মহিলা, নানা নজির উঠে আসছে। তা হলে সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই পারিবারিক আইন সংস্কারের জোরালো দাবি ওঠা উচিত নয় কি? বিশ্বের বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার করেছে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে মৌখিক তালাকের মূল্য নেই। তালাক উচ্চারণ করার পর ইউনিয়ন পরিষদ বা পুরসভার চেয়ারম্যান, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র, প্রশাসক প্রমুখ আধিকারিকদের কারও কাছে লিখিত নোটিস পাঠাতে হয়। তালাক কার্যকর হবে নোটিস পাঠানোর পর ৯০ দিন পেরোলে। তবে তার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে মিটমাটের চেষ্টা করেন তাঁরা। ইচ্ছেমতো তালাক দিলে আইনত জেল, জরিমানা হয়।

আশির দশক থেকে মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়েছে ভারতে। ১৯৭৮-এ ফৌজদারি আদালতে মাসিক ৫০০ টাকা খোরপোশ দাবি করেছিলেন স্বামী-পরিত্যক্ত শাহ বানো। মহম্মদ আহমেদ খাঁ শাহ বানোকে তালাক দিয়ে জানিয়ে দেন, শরিয়ত অনুযায়ী তিন মাস পর্যন্ত খোরপোশ পাবেন বানো। ১৯৮৫ সালে শাহ বানোর পক্ষে গেল সুপ্রিম কোর্টের রায়। কিন্তু শরিয়তে হস্তক্ষেপ করেছে আদালত, এই বলে রক্ষণশীল মুসলিমরা উত্তাল হয়েছিল। রাজীব গান্ধী সরকারের তৎপরতায় ১৯৮৬-তে পাশ হয় মুসলিম মহিলা বিল। সেখানে বলা হল, তালাক-পাওয়া মুসলিম মহিলা স্বামীর কাছ থেকে ইদ্দতকালীন তিন মাস খোরপোশ পাবেন; তার পর স্বামী আর তাঁকে খোরপোশ দেবেন না।

মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের জন্য ভারতের মেয়েরা বহু আন্দোলন করেছেন। পাঁচ মহিলার আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৭-র ২২ অগস্ট ‘তালাক-ই-বিদ্দাত’ বা তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা রদ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এই তালাক প্রথাকে নিয়মবিরুদ্ধ বলেই মনে করেন ইসলামিক পণ্ডিতরা। এই তালাক রদের আন্দোলনকেও মৌলবাদীদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। যদিও মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিভাবকপ্রতিম ধর্ম-বিশেষজ্ঞেরা জানান তাৎক্ষণিক তিন তালাক ধর্মবিরুদ্ধ, তবু রক্ষণশীলরা দাবি করেন, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে তাঁদের উপরেই আইনের ভাল-মন্দ নির্ধারণের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত। এর বিপরীতে শাহ বানো, সায়রা বানো, বেনজির হীনা— আদালতের কাছে বিচারের জন্য আবেদনকারী মেয়ের সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। একপাক্ষিক তালাক পাওয়া আরও অগণিত মুসলিম মেয়ে খবরের আলোয় নেই। তাঁদের প্রতিনিধি হয়েই শাহ বানো থেকে বেনজিরদের লড়াই। এই লড়াইকে কুর্নিশ জানানোর পাশাপাশি দাবি উঠছে, মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের উদ্যোগ জোরালো হোক মুসলিম সম্প্রদায়ের ভিতরে। কেন্দ্রের শাসক দল যেন মুসলিম মেয়েদের সুরক্ষার অছিলায় মুসলিম পুরুষদের বিপন্ন না করতে পারে।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন, বাংলা বিভাগ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Muslim Women Divorce talaq

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy