পতিতোদ্ধারিণীর বিড়ম্বনা। কাশী মিত্র ঘাট, কলকাতা। অক্টোবর ২০১৪। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ। বাজেকদমতলা বিসর্জন ঘাটের সামনে মূর্তি-সহ লরির লাইন ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। এক এক করে মূর্তি নামছে আর শাস্ত্রবিধান মেনে কয়েক পাক ঘুরিয়ে বাহকরা মূর্তিগুলোকে ছুড়ে ফেলছেন গঙ্গার জলে (ভাটার সময় হলে জলের বদলে অনেক সময় কাদায় বা জমে থাকা অন্য মূর্তির ওপর); তার পর দৌড়চ্ছেন পরের মূর্তি ফেলার বায়না নিতে। কলকাতা হাইকোর্টের বিসর্জনদূষণ সম্পর্কিত রায়কে ‘মান্যতা’ দিতে ক্রেন দিয়ে জল থেকে বড় মূর্তি তুলে রাখা হচ্ছে ঘাটের একপাশে, আর অস্থায়ী কর্মীদের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত ছোট মূর্তিদের দড়িতে বেঁধে রাখা হচ্ছে জলের ভিতরই। আর যে-সব ঘাটে ক্রেনের বন্দোবস্ত নেই, সেখানে সব মূর্তিকেই দড়িতে বেঁধে জলে গলানোর বন্দোবস্ত! রাত পোহালে পড়ে থাকা কাঠামো আর ভাঙাচোরা মূর্তিদের ঠিকানা জঞ্জাল ফেলার জায়গায়! টিভি ফুটেজে আর সংবাদপত্রের ছবিতে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার সব ঘাট। বিসর্জনের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের দাবি, গঙ্গা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। কথাটা মিথ্যে নয়, অর্ধসত্য।
প্রথমে একটা হিসেব নেওয়া যাক। শুধু দুর্গাপুজোর সময় কলকাতার ষোলো কিলোমিটার জুড়ে থাকা ষোলোটি ঘাটে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি পুজোর বিসর্জন হয়, বারোয়ারি একটি বিসর্জন মানে পাঁচটি মূর্তি ধরলে মোট মূর্তি পনেরো হাজারের কাছাকাছি। গঙ্গার ও পারে হাওড়া শহর সহ বৃহত্তর কলকাতায় গঙ্গাতীরের আরও চল্লিশটি শহর ধরলে মোট বিসর্জন দেওয়া মূর্তির সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়াবে। অন্যান্য পুজো ধরলে হবে কয়েক লক্ষ হবে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে পুরসভা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে বিসর্জনের ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে। কলকাতার তিনটি ঘাটে সবচেয়ে বেশি বিসর্জন হয়: গোয়ালিয়র ঘাট, বাজেকদমতলা ঘাট (বাবুঘাট), নিমতলা ঘাট; সেগুলির পরিকাঠামো মোটামুটি। কিন্তু সেখানেও, যখন গঙ্গাদূষণ কমানোর জন্য এক দিকে বাজেকদমতলা বা নিমতলা ঘাটে ক্রেনের বন্দোবস্ত রয়েছে দ্রুত মূর্তিগুলিকে জল থেকে তুলে আনার জন্য, সেখানেই ছোট মূর্তিদের জলের মধ্যেই বেঁধে রাখা হচ্ছে, যতক্ষণ না মাটি গলে কাঠামো বের হয়! তবুও এই তিনটি ঘাটে খানিকটা বন্দোবস্ত আছে। যত উপরে যাওয়া যায়, নদী ততই নর্দমার চেহারা নেয়। নদী জুড়ে ভাসে খড়, মূর্তির দেহাংশ, ফুলমালা, কাঠামো। ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ দফতরের নৌকা বাদে জলে কোনও সরকারি বন্দোবস্ত নেই। কোথাও স্থানীয় কিছু মানুষ কাঠামো বিক্রির জন্য চটপট দেবদেবীদের শরীর থেকে পোশাক ছিঁড়ে নিয়ে বড় কাঠামোগুলোকে জলে গলাচ্ছেন আর ছোট মূর্তিগুলিকে অবলীলায় নদীর বুকে ছেড়ে দিচ্ছেন, কেননা ওগুলির বাজার নেই! কোথাও কোথাও প্রায় সব মূর্তিই জলে ভেসে যাচ্ছে! কিন্তু জোয়ার-ভাটার খেলায় আর প্রাকৃতিক নিয়মে রাত্রি ভোর হলে ‘সাফ’ হয়ে যাচ্ছে ঘাটের আশপাশ আর দাবি জোরালো হচ্ছে: বিসর্জন দূষণমুক্ত!
নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সমীক্ষা করে দেখেছিল, বিসর্জনজনিত অন্যান্য দূষণ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মূর্তির গায়ের রং থেকে ৩২ টন ভয়ানক বিষাক্ত ধাতুদূষণ জমেছিল গঙ্গার জলে, পরিশোধনের সাধারণ প্রক্রিয়ায় যে দূষককে পুরোপুরি সরানো যায় না বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এই বিপুল দূষণ হয় খুব অল্প সময়ে গড়পড়তা ২৪ ঘণ্টায় এক লক্ষ মূর্তি বিসর্জন হয় বজবজ থেকে কল্যাণী, কমবেশি ৭০ কিলোমিটার নদীপথে, অর্থাৎ কিলোমিটার পিছু প্রতি ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০টি মূর্তি। তাই নদীর জল ও তার বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাব বিরাট।
তা হলে সমাধানের পথ কী? দু’ভাবে খুঁজতে হবে এই পথের হদিশ। আপাতত হাতে থাকা পরিকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির যোগাযোগ বাড়িয়ে একটা বিসর্জনের মাস্টার প্ল্যান তৈরি ও তার প্রয়োগ করতে হবে। দেখতে হবে, যেন বিভিন্ন ঘাটে বিসর্জন দেওয়া প্রতিমার সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। যেমন কলকাতার দইঘাট বা নাথের ঘাটে আরও অনেক বেশি মূর্তির বিসর্জন হতে পারে, কিন্তু অন্য দিকে গোয়ালিয়র ঘাটে কমানো উচিত বিসর্জনের সংখ্যা। এই পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কর্পোরেট ও অন্যদের। কেন্দ্রীয় সরকার এখন গঙ্গা নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে, তার কাছে দরবার করা যেতে পারে, বিসর্জনের সময় গঙ্গা দূষণমুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করুক তারা। আর, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা ক্লাবগুলির কাছে সামান্য বিসর্জন-মূল্য চাইলেও, আশা করা যায়, প্রতিবাদ করবে না তারা।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে চাই নতুন ভাবনা। সেই ভাবনা হয়তো বা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বিসর্জনের পথ, কল্যাণীর বিসর্জনের পথ বা সবার উপরে নৈহাটি অঞ্চলে কালীপুজো বিসর্জনের পথ। চন্দননগরের প্রতিমা খুব দ্রুত জল থেকে তুলে ফেলা হয়, ফলে খুব বেশি জলদূষণ হয় না, আর কল্যাণীতে একটি নির্দিষ্ট জলাশয়ে বিসর্জন করে বিসর্জন-পরবর্তী সময়ে সেই জলাশয়টিকে দূষণমুক্ত করা হয়। তবে সবচেয়ে ভাল উপায় সম্ভবত ‘নৈহাটি মডেল’। সেখানে বিশালকায় কালীমূর্তিকে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার বদলে গঙ্গাকে নিয়ে আসা হয় মূর্তির কাছে! যাবতীয় ধর্মীয় বিধান মেনে গঙ্গার জল দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিসর্জন সেরে তার পর হোসপাইপের জল দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয় দেবীমূর্তি। মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি আবার মাটিতেই মিশে যায়। যদি এমনটা নৈহাটিতে হতে পারে, কলকাতায় বা অন্য শহরে নয় কেন? কলকাতায় যে সব প্রথম সারির পুজোর উদ্যোক্তারা সিসাহীন রঙের ব্যবহার বা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে দেশে মডেল হয়েছেন, তাঁরা কেন গঙ্গা বাঁচানোর এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেবেন না? এটা শ্লাঘার কথা যে, ইতিমধ্যেই শহরের কয়েকটি পুজো ‘ধোওয়া এবং গলিয়ে দেওয়া’ মডেলে মূর্তি বিসর্জনে সম্মতি জানিয়ে পুরসভাকে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে কলকাতা পুরসভা, দূষণ পর্ষদ, কলকাতা পুলিশ ও প্রয়োজনে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সংস্থার সাহায্য নিতে পারে। প্রয়োজনে কোনও একটি ঘাটকে নির্দিষ্ট করে সেখানে এমন মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ জন্য চাই সামাজিক সম্মতি। পরের বছরের মারকাটারি থিমের ভাবনার পাশাপাশি ক্লাবগুলি মা-গঙ্গাকে বাঁচাতে এমন ভাবনা এখনই শুরু করতে পারেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy