Advertisement
E-Paper

ফুকো যদি দেখিতেন

আইনের চোখে সকলে সমান কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু জেলখানায় কেহ কেহ অবশ্যই বেশি সমান। বিশেষত বন্দি যদি হন ক্ষমতার আশীর্বাদপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা কিংবা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। যখন সকল বন্দিকে সাধারণ ভাবে জেলের ভাত খাইতে হয়, তখন তথাকথিত ভিআইপি বন্দিদের জন্য পৃথক বন্দোবস্ত থাকে। কাহারও বাড়ি হইতে নিয়মিত চার বেলা খাবার আসে, পানীয়ও।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১

আইনের চোখে সকলে সমান কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু জেলখানায় কেহ কেহ অবশ্যই বেশি সমান। বিশেষত বন্দি যদি হন ক্ষমতার আশীর্বাদপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা কিংবা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। যখন সকল বন্দিকে সাধারণ ভাবে জেলের ভাত খাইতে হয়, তখন তথাকথিত ভিআইপি বন্দিদের জন্য পৃথক বন্দোবস্ত থাকে। কাহারও বাড়ি হইতে নিয়মিত চার বেলা খাবার আসে, পানীয়ও। এমনকী অভিযোগ, সেই পানীয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সুরাও মিশ্রিত থাকিতে পারে। প্রায় সকল বন্দিই যেখানে বহির্জগৎ হইতে কার্যত নির্বাসিত, নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বে দিনযাপন করিতে বাধ্য, কিছু বন্দি তখন বাহিরের মুক্ত পৃথিবীর সহিত নিয়মিত সংযোগরক্ষা করিয়া চলেন, তাঁহাদের নাগালে সেলফোনের ছড়াছড়ি। দেশের প্রায় সর্বত্র, এমনকী দিল্লির তিহাড় সংশোধনাগারেও ভিআইপি বন্দিরা রকমারি বিশেষ সুযোগসুবিধা পাইয়া থাকেন। এই অসাম্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলা উচিত নহে। গণতান্ত্রিকতা ভারতীয় প্রশাসনের মজ্জায় এখনও প্রবেশ করিতে পারে নাই।

এই ধরনের বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। অন্য সব বন্দিকে যেখানে ঠাসাঠাসি করিয়া আলোহীন, অপরিসর কুঠুরিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঢুকাইয়া রাখা হয়, নিত্য মারধর, তোলা আদায় এমনকী যৌন হেনস্থারও শিকার হইতে হয়, সেখানে ভিআইপি বন্দিদের জন্য মশারি টাঙাইয়া তাহা গুঁজিয়া দেওয়ার সুখস্বাচ্ছন্দ্যও মঞ্জুর— অন্যায়, অনৈতিক। কিন্তু জেল-প্রশাসনের আমূল সংস্কার ছাড়া জেলখানা যথার্থ সংশোধনাগার হইয়া উঠিতে পারে না। ভিআইপি বন্দিদের প্রতি সামন্ততান্ত্রিক পক্ষপাত ও আনুগত্য প্রদর্শনের অনৈতিকতাও রদ হইতে পারে না। কিন্তু জেল-কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের আচরণের উপর নজর রাখিবে কে? অভিযোগ, তাঁহারাই স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া ভিআইপিদের বিশেষ সুযোগ দেন এবং সাধারণ বন্দিদের ন্যূনতম প্রাপ্য হইতেও বঞ্চিত করেন। প্রভাবশালীর সামনে নত হওয়া এবং সাধারণকে অবজ্ঞা করার মানসিকতা হইতে কারা-কর্তাদের মুক্তির হদিশ কে দিবে? জেলখানা সমাজেরই প্রতিবিম্ব।

পশ্চিমবঙ্গ হয়তো এই বৈষম্যের ধারা হইতে কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র ছিল। কিন্তু আর নাই। আলিপুর সংশোধনাগারে সারদা কেলেংকারি মামলায় বন্দি রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রীর নাকি জেলের মধ্যেও আরাম-আয়েশের যাবতীয় উপকরণ মজুত রহিয়াছে। দুষ্ট লোকে বলে, ‘অসুস্থ’ বোধ করিলেই সরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে যাওয়ারও সুযোগ রহিয়াছে। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। শোনা যায়, কারাগারেও তিনি স্বরাট। জেলকর্মীরা বোধ করি তাঁহার কথা অমান্য করিতে তত সাহস দেখাইতে পারিতেছেন না। হয়তো বা তাঁহারা মিত্রমহাশয়ের দাপটে তটস্থ। কারাগারে থাকিতে পারেন, কিন্তু ভুলিলে চলিবে না, তিনি এখনও মন্ত্রী। মিশেল ফুকো কারাগারের দৃষ্টান্ত সহকারে শিখাইয়া গিয়াছেন, অথরিটি-র দাপট সর্বময়, অদৃশ্য চোখ দিয়া সে সব কিছুই নজর করিতে পারে। মুশকিল হইল, তিনি মদন মিত্রদের পশ্চিমবঙ্গকে না দেখিয়াই তাঁহার মত দিয়াছিলেন। এই রাজ্য ‘কর্তৃপক্ষ’র চেনা ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করে। পশ্চিমবঙ্গে প্যানঅপটিকন এক এবং অদ্বিতীয়। সেই সর্বদ্রষ্টার সুনজর যদি কাহারও উপর থাকে, তাহা হইলে ফুকোর ধারণাটি হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হইয়া যায়। তখন বন্দিই হইয়া উঠে সর্বময় কর্তৃপক্ষ।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy