Advertisement
E-Paper

মেধা বা যোগ্যতা আকাশ থেকে পড়ে না

উচ্চ ও পেশাদারি শিক্ষায় ‘পিছিয়ে পড়া’ অংশের প্রতিনিধিত্ব না বাড়ালে পশ্চাত্‌পদ অঞ্চলগুলিকে উন্নত করা যাবে না। সংরক্ষণ এখানেই বড় ভূমিকা নিতে পারে। লিখছেন মানবী মজুমদার, অভিজিত্‌ চৌধুরী, অচিন চক্রবর্তী, দিলীপ ঘোষ ও কুমার রাণা।স্বপ্নেও ভাবিনি আমার মেয়ে বিশ্বভারতীতে পড়তে পারবে।’ কথাটা বলেছিলেন যিনি, তিনি পেশায় খেতমজুর, ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, নিবাস বাসাপাড়া, বোলপুর থেকে ঘন্টাখানেকের রাস্তা। বাস্তবিকই, কবির স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে আজও সমাজের একাংশের ঠাঁই হয়নি, কেননা তারা ‘যোগ্যতার প্রমাণ’ দিতে পারেনি।

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
‘যোগ্যতা’র নামে। মেডিক্যাল কলেজে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। দিল্লি, ২০০৮।

‘যোগ্যতা’র নামে। মেডিক্যাল কলেজে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। দিল্লি, ২০০৮।

স্বপ্নেও ভাবিনি আমার মেয়ে বিশ্বভারতীতে পড়তে পারবে।’ কথাটা বলেছিলেন যিনি, তিনি পেশায় খেতমজুর, ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, নিবাস বাসাপাড়া, বোলপুর থেকে ঘন্টাখানেকের রাস্তা। বাস্তবিকই, কবির স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে আজও সমাজের একাংশের ঠাঁই হয়নি, কেননা তারা ‘যোগ্যতার প্রমাণ’ দিতে পারেনি। ওই মেয়েটির ‘যোগ্যতা’ গড়ে উঠেছে তার সামাজিক প্রেক্ষাপটের বৃত্তে, চিরকালীন সুযোগবঞ্চনার মধ্যে: এক দিকে অর্থাভাব, অন্য দিকে দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার অকল্যাণে বিত্তবান ও সামাজিক দিক দিয়ে অগ্রসরদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া, এই ছিল তার ভবিতব্য। এ পরাজয়ে তার কিছু করার ছিল না, প্রতিযোগিতার নিয়মাবলি বাঁধাই হয়ে আছে তাকে সুযোগ-বহিষ্কৃত করে রাখার জন্য।

তবুও যে খেতমজুরের মেয়েটি নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারল, তার মূলে বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায্যতার ক্রমবর্ধমান দাবি: সকলের জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশেও যার প্রভাব খুব স্পষ্ট। এই ব্যাপ্তি থেকে সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের একটা বড় অংশকে সংরক্ষণের মাধ্যমে অন্যান্য পশ্চাত্‌পদ শ্রেণির আওতায় আনা হয়েছে, যার ফলে তাঁরা শিক্ষায় ও চাকরিতে প্রতিযোগী হয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করছেন। কেরল বা তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে থেকে যে বিরাট সুফল অর্জন করেছে, সেটা আমাদের সরকারি নীতিতে তেমন গুরুত্ব পায়নি। ‘মেধা’র দোহাই দিয়ে সমাজের একটা অংশকে পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে, সংরক্ষণের সঙ্গে তার কোনও বৈরী সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও। দেরিতে হলেও এ রাজ্যে সরকারি নীতিতে সামাজিক ন্যায্যতার ও সমাজের ব্যাপকতর অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটা গুরুত্ব পেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এক দিকে যখন অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি বিবেচিত হচ্ছে, অন্য দিকে তখন এটাকে নাকচ করার এক জোরালো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসি’দের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো অনেকটাই ‘মেধার জন্য মুক্ত’ করে দেওয়া হল। অস্যার্থ, সুযোগ-বঞ্চিত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের সামান্য সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া হল। বলা হচ্ছে, এই আসনগুলোর জন্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। যাদবপুর থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটাগুলো পূরণ হতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের ‘কাট-অফ’ নম্বর না থাকার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার উপযোগী বলে গণ্য না করলে আসন পূরণের গোড়াটাই তো কেটে দেওয়া হল। এমন নিয়মের ফলে এই ছেলেমেয়েদের সংবিধানস্বীকৃত সংরক্ষণের সুবিধাও দেওয়া গেল না। যোগ্যতা নিরূপণের মাপকাঠি যদি সামাজিক বৈষম্যের ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন হয়, তা হলে মেধাও ঠিকমত যাচাই করা যায় না, বৈষম্যের জগদ্দল পাথরও সরানো যায় না। সে কারণেই সংবিধানে সংরক্ষণের নীতি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ভাবে অবহেলিত ছাত্রছাত্রীরা যাতে প্রবেশের সুযোগ পায় ও সেই শিক্ষায়তনগুলির নিবিড় প্রচেষ্টায়, যেমন, লিঙ্ক কোর্স, ব্রিজ কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে, তাদের যোগ্যতার ঠিকঠাক বিকাশ ঘটাতে পারে, সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়কে কিছুটা প্রশমিত করে। সংরক্ষিত আসনগুলির অ-সংরক্ষণ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিপরীত স্রোত তৈরি করছে।

পেশাগত শিক্ষার অঙ্গনগুলিতেও ‘সুযোগ-বহিষ্কার’-এর প্রক্রিয়া চলছে। পরিণত গণতন্ত্রের রূপ নিতে ব্যগ্র রাষ্ট্র যখনই কাগজে কলমে এদের প্রতি দীর্ঘকালের বঞ্চনার প্রতিকারের উদ্যোগ নেন, তখনই সুবিধাভোগীরা বাধার সৃষ্টি করেন। আইনের মধ্যে থেকেই তাকে বানচাল করার প্রচেষ্টা করা হয়। নব্বইয়ের দশকে, ‘মণ্ডল কমিশন’-এর সুপারিশ অনুযায়ী, ক্ষীণাকারে হলেও যখন পেশাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার চেষ্টা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধতা করেছিলেন এইম্স সহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে কিছু ‘আগমার্কা মেধাবী’ ছাত্রছাত্রী। সরাসরি আইনের পথে বিরুদ্ধতা করার ফাঁকফোকর না পেলে রাষ্ট্রের তৈরি করা নিয়ম কখনও কখনও ভুলে যান রূপায়ণকারীরা। তথাকথিত ‘মেধা’র ধোঁয়াশায় ঢাকা এই শিক্ষাব্যবস্থা আর কত ‘চূণী কোটাল’-এর বলি চড়াতে চাইছে?

কিন্তু সত্যিই কি মেধা নিয়ে তত মাথা ঘামায় এই দেশ? দেশের ৩৮২টি মেডিক্যাল কলেজের ৬৫ শতাংশ আসন পূরণ করা হয় সব সরকারি নিয়মের বাইরে। এই সিটগুলো বাজারে বিকোয় কোটি টাকা দরে। কখনও নিলামে ওঠে। আর্থিক ক্ষমতাবান বা সামাজিক প্রতিপত্তিমান ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাই কেবল এ সব সিটের জন্য ‘মেধাবী’ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন।

আর পশ্চিমবঙ্গের তো কথাই নেই। বছরের পর বছর মেডিক্যালে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো ভর্তি হয় না, মেডিক্যাল কাউন্সিলের ফতোয়ায়। অথচ প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদণ্ড হচ্ছেন কোটায় পাশ করা ডাক্তারেরা। অনেক রাজ্যই কাউন্সিলের অন্যায় দাবিটা মানছে না, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে দলে দলে রোগী ভেলোর যাচ্ছেন, তাঁদের সুচিকিত্‌সার ভার কোটার ডাক্তাররাই বহন করেন। আর আমরা সংরক্ষণ যে সাংবিধানিক দায়, সেটাও কত সহজে ভুলে যাই।

সংরক্ষণ নিয়ে কথা উঠলেই শুধু ভাবা হয়, ‘যোগ্যতার নিরিখে খাটো’ কিছু ছাত্রছাত্রী কতটা সুযোগ পাচ্ছে। সমাজের বিবিধ অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসা ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে পড়াশোনা করলে সবারই যে চিন্তার প্রসার বাড়ে, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবত্তদের, আমরা তা ভুলে যাই। অথচ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে পারি, বা একটু এগিয়ে দিল্লি বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়কে, যারা এই কাজটি সম্পন্ন করে সামাজিক প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করছে।

উচ্চশিক্ষার প্রসার নিয়ে রাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। গ্রামাঞ্চলে কাজ করার জন্য শিক্ষক, চিকিত্‌সক, প্রযুক্তিবিদদের প্রয়োজন বাড়ছে। নিম্নবর্গীয় সমাজে জন্মালেই তিনি সেই সমাজকে উন্নত করার কাজে নিয়োজিত হবেন, কিংবা উচ্চবর্ণে জন্মালে তার উল্টোটা হবে, ব্যাপারটা এত সরল নয়। কিন্তু এটা ঠিক যে, উচ্চ ও পেশাদারি শিক্ষায় সামগ্রিক ভাবে ‘পিছিয়ে পড়া’ অংশের প্রতিনিধিত্ব না বাড়ালে পশ্চাত্‌পদ অঞ্চলগুলিকে উন্নত করা যাবে না। বৈষম্যের অসমান ভূমিতে ‘মেধার দীপশিখা’ ইতস্তত ম্লান হয়ে জ্বলবে। তার জন্য প্রয়োজন, প্রদীপের জ্বলার ক্ষমতা বাড়ানো, সমান ভাবে। বাসাপাড়ার মেয়েটির ডানামেলা স্বপ্নকে রূপায়িত করেই দেশ ডানা মেলতে পারে। সংকোচন-মত্ত কর্তৃপক্ষ দেশের ভবিষ্যতের কথা কি ভাববেন?

post editorial manabi majumdar avijit choudhury achin chakraborty kumar rana dilip ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy