Advertisement
E-Paper

মানুষকে কাছে টানার ত্রিশ বছর

ওঁরা বন্ধ কারখানার কর্মী। ওঁদের তো শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের কাছে বাকি জীবনীশক্তি সঁপে দেওয়ার কথা। কান্নাকাটির কথা। কিন্তু তা ওঁরা করেননি। লিখছেন সুকান্ত সরকারদেখতে দেখতে তিন দশক। উদ্যোগের। সাফল্যের। অহঙ্কার দেখানোর বা তৃপ্ত হওয়ার সময় নেই ওঁদের। যত এগিয়েছে, তত বেড়েছে দায়বদ্ধতার বৃত্তটি। মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে করে বাড়িয়ে চলেছে ওঁদের বৃত্তের বলয়টি। ওঁরাও মানুষকে টেনে নিয়েছেন। ওঁদের কাজে অনেকেই মজে রয়েছেন। অনেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০

দেখতে দেখতে তিন দশক। উদ্যোগের। সাফল্যের। অহঙ্কার দেখানোর বা তৃপ্ত হওয়ার সময় নেই ওঁদের। যত এগিয়েছে, তত বেড়েছে দায়বদ্ধতার বৃত্তটি। মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে করে বাড়িয়ে চলেছে ওঁদের বৃত্তের বলয়টি। ওঁরাও মানুষকে টেনে নিয়েছেন। ওঁদের কাজে অনেকেই মজে রয়েছেন। অনেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

ওঁরা একটি বন্ধ কারখানার কর্মী। ওঁদের তো বিশালাকার শ্রমিক সংগঠন এবং নামডাকওয়ালা শ্রমিক নেতাদের কাছে বাকি জীবনীশক্তি সঁপে দেওয়ার কথা। শ্রম দফতরের এ ঘরে ও ঘরে কান্নাকাটির কথা। কিন্তু তা ওঁরা করেননি। কারখানা বন্ধ হলেও হাত-পা-মাথা চালু রেখেছিলেন। দয়া চাননি। অন্ধকারে নিজেরাই একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালিয়েছেন ওঁরা।

আজ থেকে বছর ত্রিশ আগে বন্ধ হয়ে যায় বেলুড়ের ইন্দো-জাপান স্টিল কারখানা। তার কিছু আগে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের বেশ ক’জনের সঙ্গে কারখানার কর্মীদের আলাপ হয়। ক্রমশ বাড়তে থাকে যোগাযোগ। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছু দিন আগে থেকেই ওই কর্মীরা দুঃসাহসিক এক কাজ শুরু করে বসলেন। ওই তরুণ ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়ে বালিতে এক কর্মীর বাড়িতে চালু করলেন ছোট্ট এক ক্লিনিক। কিছু দিন পরে কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে এক টুকরো জমিও আদায় করে ফেললেন তাঁরা। সেখানেই ওই সমাজমনস্ক ডাক্তারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তুললেন শ্রমজীবী হাসপাতাল।

সাধারণ মানুষ ও শুভার্থীদের দানে সমবায় বেশ খানিকটা প্রসারিত হলেও জমির অভাবে বাড়ানো যায়নি হাসপাতালটিকে। প্রথম দিকে শুধু এলাকার গরিব মানুষেরাই আসতেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বেলুড়-বালির সীমানা ছাড়িয়ে শ্রমজীবী হাসপাতালের খবর ছড়িয়ে গেল। আশপাশ থেকে তো বটেই, রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করল। ওঁরা কাউকে দয়া দেখিয়ে চিকিৎসা করেন না। রীতিমত গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয়। তবে, তা তুলনায় কম। ‘কম’ নয়, শুধরে দিয়ে হাসপাতলের অন্যতম কারিগর ফণিগোপাল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “এখানে সঠিক মূল্যে চিকিৎসা করা হয়।”

নকশাল? হ্যাঁ এবং না। শুরু করেছিলেন কারখানার নকশালপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন ও জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের কয়েক জন। তাই, প্রথমেই ‘নকশাল’ তকমা লেগে গেল। যাঁরা সে তকমা লাগিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পরবর্তী কালে কবুল করেছিলেন ‘শ্রমজীবী হাসপাতালের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা’র কথা। প্রশাসনকেও কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু দিনে দিনে নানা মতের, নানা রঙের মানুষজন শুধু নয়, স্থানীয় ডাক্তারদের পাশাপাশি কলকাতার বহু ডাক্তারও জড়িয়ে পড়লেন। ত্রিশ বছর ধরে মানুষ দেখেছেন, শ্রমজীবীতে কোনও রাজনীতির নামগন্ধ নেই।

ভিড় বাড়তে লাগল। আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল নানা রকমের অত্যাচার। স্থানীয় মাতব্বরদের হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মারধর থেকে রোগী-সমেত বেড জিটি রোডে নামিয়ে দেওয়া। পুলিশ? প্রশাসন? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু বন্ধ কর্মীরা ইস্পাতের মতো সোজা হয়ে থাকেন। তত দিনে স্থানীয় মানুষ একটু একটু করে ওঁদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। বামফ্রন্টের শরিক দল আরএসপি। বেলুড়ে আরএসপি-র নেতা অরুণজিৎ সিংহ-সহ এলাকার একাধিক বিশিষ্ট মানুষ প্রকাশ্যে শ্রমজীবীর পাশে দাঁড়ালেন। পরে অবশ্য, তখনকার শাসক দলের বড় একটি অংশ পরোক্ষে পাশে দাঁড়ায়। বেলুড় মঠ-লাগোয়া এই হাসপাতাল মঠের সন্ন্যাসীদের শুভেচ্ছাও পায়।

এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা বিদেশি অনুদান কোনও কিছুই নেয়নি এই হাসপাতাল। কী ভাবে চালাচ্ছেন? “কেন! রোগীরা তো পয়সা দিয়ে চিকিৎসা করায়। তা ছাড়া, অনেক মানুষের ব্যক্তিগত দানেই কাজ চলে যায়।” শ্রমিক-কর্মী ইউনিয়নের দানও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে বাইপাস সার্জারি মাত্র ২৫ হাজার টাকায় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এর জন্যে ‘হৃদয় ছুঁয়ে’ নামে একটি তহবিল তৈরির কথা ঘোষণা করা হল। সেই সময় সাধারণ মানুষের পাশপাশি দু’তিনটি ব্যাঙ্কের কর্মী ইউনিয়নও বাইপাস সার্জারির জন্য পরিকাঠামো তৈরি করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল।

ভিড় সামলাতে বড় জায়গার দরকার হয়ে পড়ল। শ্রীরামপুর শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে বেলুমিল্কিতে জমির সন্ধান পাওয়া গেল। সেখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পাঁচশো শয্যার হাসপাতাল। ইতিমধ্যে বহির্বিভাগ ছাড়াও দেড়শো শয্যার হাসপাতাল চালু হয়ে গিয়েছে। তহবিল গড়ার জন্য ‘আবার হৃদয় ছুঁয়ে’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ভাবে কত দিন চলবে? বেলুড়ে শ্রমজীবী হাসপাতাল সম্প্রসারণের অবকাশ আছে কি? ফণিগোপালবাবু জানালেন, ইন্দো-জাপান কারখানার বিশাল জমি পড়ে রয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সরকারি কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গিয়েছে পুরো জমিটাই খাস জমি। সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে, ওই জমির একটা অংশ হাসপাতাল সম্প্রসারণের জন্য দেওয়া হোক। সরকারি দামেই। যে জেদ আর ধৈর্য এই হাসপাতালকে একটি ‘মডেল’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সেটাই সম্বল করে অপেক্ষা করছেন শ্রমজীবীর কারিগররা।

sukanta sarkar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy