ঘে রাও যেখানেই হোক, ভয়ানক। সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঢোঁক গিলিয়া বলিয়াছেন, শ্রমিক আন্দোলনকে তিনি খাটো করিয়া দেখেন না, কিন্তু চটকলে যাহা চলিতে পারে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তাহা চলে না। মন্ত্রিবর ভুল বলিয়াছেন। ‘ঘেরাও’ নামক বিশৃঙ্খলাটি কোথাও চলিতে পারে না। যাদবপুর-প্রেসিডেন্সিতেও নহে, গঙ্গাতীরের চটকলেও নহে। ‘ঘেরাও’-এর প্রতি বাঙালির খানিক মমত্ব থাকা স্বাভাবিক, কারণ আধুনিক ইংরাজি অভিধানে এই শব্দটি (পশ্চিম)বঙ্গের দান। প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিশৃঙ্খলার আনুষ্ঠানিক স্রষ্টা। তাহার পর বাঙালি শিখিয়া লইয়াছে, সর্ব রোগের ইহাই এক দাওয়াই। চটকলে মালিকপক্ষের সহিত অশান্তি থাকিলে, এমনকী না থাকিলেও, ঘেরাও করিয়া রাখিলেই সিদ্ধি। কলেজেও একই ফল। অধ্যক্ষকে ঘেরাও করিতে পারিলে ফেল করা ছাত্রও দিব্য ক্লাসে উঠিয়া যায়। ছাত্রদের দেখিয়া শিক্ষকরা শিখিয়াছেন, অধ্যক্ষরাও। শিখিবার বয়স নাই, শিখিতে লজ্জাও নাই, অতএব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ধশতবর্ষে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষরা উপাচার্যকে ঘেরাও করিয়াছিলেন। অর্ধশতকের এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিতে সুব্রতবাবুর সম্ভবত অস্বস্তি হইয়াছে। ফলে, যে কোনও প্রতিষ্ঠানেই যে ‘ঘেরাও’ নামক অস্ত্রটির প্রয়োগ অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক, এই কথাটি তিনি বলিয়া উঠিতে পারেন নাই।
ছাত্রদের তিরস্কার করিবার ঝোঁকে মন্ত্রিমহোদয় বলিয়াছেন, তাঁহারাও ছাত্র রাজনীতি করিতেন, কিন্তু এমন বিশৃঙ্খলা করেন নাই। তাঁহাদের আমলে ছাত্র রাজনীতির নামে যাহা হইত, সেই উদাহরণ হইতে আজিকার ছাত্ররা শিখিতে আরম্ভ করিলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকিবে না। কাজেই, সে প্রসঙ্গ থাকুক। বরং, ভাবিয়া দেখা যাউক, পেশাদার রাজনীতি আসিয়া ছাত্র অথবা শ্রমিক আন্দোলনকে লইয়া না গেলে কি আজিকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হইতে পারিত? ঘেরাওয়ের তীব্র অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রকৃত প্রস্তাবে আত্মঘাতী। কর্তৃপক্ষ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থপূর্ণ সংলাপের সম্ভাবনা ঘেরাও নষ্ট করিয়া দেয়। ফলে, চটকলের শ্রমিকই হউন অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘেরাও শুধুমাত্র দূরত্ব সৃষ্টি করে। বহিরাগত রাজনীতির ব্যাপারিরা এই দীর্ঘমেয়াদি সংলাপে আগ্রহী নহেন, কারণ সেই সংলাপ হইতে তাঁহাদের কিছু পাওয়ার নাই। তাঁহারা তাৎক্ষণিকের লাভ খোঁজেন। ঘেরাও তাঁহাদের অস্ত্র— বন্দুকটি তাঁহারা ছাত্র বা শ্রমিকদের ঘাড়ে রাখিয়া চালান, এইমাত্র। স্বাভাবিক কারণেই মন্ত্রিমহোদয় এই সব কথা তোলেন নাই।
তবে, নিজের অজান্তেই তিনি রাজনীতির শ্রেণিচরিত্রটি প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছেন। যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির সহিত চটকলকে এক পঙ্ক্তিতে বসাইবার ‘ভুল’টি সংশোধন করিয়া লওয়ার মাধ্যমে। অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন চটকলের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ, মন্ত্রিবর বলেন নাই। অন্য কোনও দিন হয়তো তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে চটকলের সহিত এক বন্ধনীতে রাখিয়া ফের জিভ কাটিতেন। সুব্রতবাবু সম্ভবত ব্যতিক্রম নহেন। রাজনীতিকরা নিজের অবচেতনেই চটকলের ন্যায় শিল্পকে খরচের খাতায় ফেলিয়া দিয়াছেন। অর্থনীতির যুক্তিতেই চটকলগুলি অধিকাংশ মারা যাইত, কিন্তু আর যে ভারী শিল্পগুলি রাজ্যে ছিল, সব কয়টির গঙ্গাযাত্রা অনিবার্য ছিল না। প্রথমে ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিপনায় শিল্পগুলির মৃত্যু নিশ্চিত করা হইল, তাহার পর ধরিয়া লওয়া হইল, এই ক্ষেত্রগুলি যেহেতু মৃত, অতএব সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের জঙ্গিপনাই চলিতেছে, চলিবে। স্বয়ং গার্সিয়া মার্কেসও বুঝি একটি প্রাক-নির্ধারিত মৃত্যুর এমন দিনপঞ্জি রচনা করিতে পারিতেন না। বঙ্গের রাজনীতি পারিয়াছে।