Advertisement
E-Paper

যে পথে গ্রামে পৌঁছনো যায়

আমাদের ব্যাঙ্কগুলো যদি ছাগল ধরার কাজটাকে ব্যবসার সুযোগ হিসাবে দেখত, তা হলে হয়তো সারদা কাণ্ড ঘটত না আর অমিতাভদাকেও চাকরি ছাড়তে হত না। এখন অমিতাভদা (নাম পরিবর্তিত) আর্থিক বাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত। আশির দশকে স্টেট ব্যাঙ্কের প্রোবেশনারি অফিসারের পরীক্ষায় সফল হয়ে তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৪ ০০:৩৪

আমাদের ব্যাঙ্কগুলো যদি ছাগল ধরার কাজটাকে ব্যবসার সুযোগ হিসাবে দেখত, তা হলে হয়তো সারদা কাণ্ড ঘটত না আর অমিতাভদাকেও চাকরি ছাড়তে হত না।

এখন অমিতাভদা (নাম পরিবর্তিত) আর্থিক বাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত। আশির দশকে স্টেট ব্যাঙ্কের প্রোবেশনারি অফিসারের পরীক্ষায় সফল হয়ে তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তখন দেদার কৃষি ঋণের যুগ। কিন্তু অমিতাভদার কাজ ছিল অফিসে বসে বসে স্কেল দিয়ে মাছি মারা আর অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করা।

কাল হল স্থানীয় নেতার নির্দেশে গ্রামের এক বৃদ্ধাকে গরু কেনার টাকা ধার দেওয়ায়। গরু সারা দিন চরত, যেমন সব গরুই চরে। সন্ধের মুখে ব্যাঙ্কে ঝাঁপ ফেলে বাড়ি যাওয়ার মুখে বৃদ্ধা এসে হাজির হতেন, ‘ও ছেলে, সে তো ঘরে ফিরল না গো!’ অতঃপর ব্যাঙ্কের অফিসারকেই গরু খুঁজতে যেতে হত। অ্যাসেটট হারিয়ে গেলে তো সর্বনাশ! ‘এর পরে যখন ছাগলও খুঁজতে বেরোতে হল, তখন বুঝলাম এ লাইন আমার নয়!’

সংস্কার-উত্তর ভারতে কোনও ব্যাঙ্কই ছাগলের খোঁজে দৌড়তে রাজি ছিল না। কারণ তাদের কাজের বহর ও খরচের সঙ্গে সাধারণ ছোট গ্রামের চাহিদা ও দাবির মধ্যে ফারাক আকাশপাতাল। এক সমীক্ষা বলছে, সরকারি ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের শাখার মাধ্যমে গ্রামে যখন টাকা ধার দেয় তখন ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। অথচ যখন মাইক্রোফিনান্স সংস্থার মারফত এই টাকা ধার দেয়, তখন এই ক্ষতি কমে দাঁড়ায় ৫ শতাংশ। এই ক্ষতিই হয়তো উল্টে বড় লাভের সূত্র হতে পারত, যদি ছাগল খোঁজার কাজটাকে ব্যবসার সুযোগ হিসাবে দেখত বড় আর্থিক সংস্থাগুলো।

স্টেট ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান প্রতীপ চৌধুরি প্রতিটি গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগকে, যার পোশাকি নাম ফিনান্সিয়াল ইনক্লিউশন, গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথম থেকেই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে শাখা খোলার বিরোধী। তাঁর যুক্তি, দশ টাকার মানি অর্ডার গ্রামে পৌঁছতে সরকারের পাঁচশো টাকা খরচ হয়। এতে রাজনীতির সুবিধা হলেও, অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়ে। একই ভাবে, ৩০ শতাংশ ক্ষতি স্বীকার করে কোন ব্যাঙ্ক সুস্থ মস্তিষ্কে গ্রামে ব্যবসা করতে যাবে? বেশির ভাগ ব্যাঙ্ক কর্তারই বক্তব্য অনুরূপ।

ব্যবসায়িক কারণে ব্যাঙ্ক গ্রামে শাখা খুলতে চায় না। বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী দুনিয়ায় গড়ে ৫০ শতাংশ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, ভারতে মাত্র ৩৫ শতাংশের। ভারতে ১ লক্ষ ২ হাজার ৩৪৩টি শাখা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের। তার মধ্যে মাত্র ৩৭ হাজার ৯৫৩টি গ্রামে। আর গ্রামীণ শাখার প্রায় প্রতিটিই সরকারি ব্যাঙ্কের। মাত্র ১ হাজার ৯৩৭টি শাখা বেসরকারি ব্যাঙ্কের।

সরকার এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে মানুষের দরজায় কী ভাবে নিয়ে যাওয়া যায় তা খতিয়ে দেখতে রঙ্গরাজন কমিটি তৈরি হয়েছিল। ২০০৮ সালে এই কমিটির রিপোর্টকে আধার করেই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচি তৈরি করা হয়। এখন যে কোনও ব্যাঙ্ককেই চারটে নতুন শাখা খুললে তার মধ্যে অন্তত একটা, ব্যাঙ্ক নেই এমন গ্রামে খুলতেই হবে। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হবে না, তা বুঝেই রঙ্গরাজন কমিটি মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়ার উপর জোর দেয়। বলা হয়, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে, তার ফলে এরা যে ভাবে স্থানীয় চাহিদা বুঝে পরিষেবা দিতে পারবে তা বড় ব্যাঙ্কগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। কেন, সেটা ওই ছাগল খোঁজার গল্পই জানিয়ে দেয়। ছাগল পালানো কী ভাবে আটকানো যায় সেই ভাবনায় যাওয়ার ব্যবস্থা প্রথাগত ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামোর ধাতে নেই, অমিতাভদার মতো যাঁরা ব্যাঙ্কে কাজ করতে যান তাঁদেরও ধাতে নেই। সেখানেই মাইক্রোফিনান্স সংস্থার সাহায্য মূল্যবান।

অধুনা ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স পেয়ে এমনকী উচ্চকোটি মহলেও বন্দিত হয়েছেন মাইক্রোফিনান্স সংস্থা বন্ধন-এর প্রাণপুরুষ চন্দ্রশেখর ঘোষ। ওঁরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যান। ধার দেন গরু, ছাগল কেনা বা অন্য কোনও অর্থকরী কাজ শুরু করতে। একটা গ্রামে ওঁরা একটি দরিদ্র পরিবারকে ছাগল কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন ধার হিসাবে। সেই ছাগল রাতারাতি হারিয়ে যায়। অমিতাভদার মতোই অভিজ্ঞতা। কিন্তু পরের পর্যায়টা একেবারেই অন্য রকম।

ছাগল হারানোর কথা জানতে পেরে ওঁরা গ্রামের মাতব্বর গোত্রীয়দের সঙ্গে বসলেন। গ্রামের মানুষ জানেন এই সব চুরি কে করে। তাঁরাই ঠেকাতে পারেন এই প্রবণতা। মাতব্বরদের বোঝানো হল, এর ফলে কী ক্ষতি হচ্ছে। তাঁরা রাজি হলেন ছাগল চুরি ঠেকাতে। কাজ হল।

এই ভাবে অমিতাভদারা ভাববেন না, তার কারণ তাঁদের কাছে গ্রামীণ শাখায় পোস্টিং হল একটা সাময়িক ঝামেলা মাত্র, চাকরির শর্ত অনুযায়ী যা কিছু দিন সহ্য করতে হয়। তেমনই ব্যাঙ্ক কর্তারাও, গ্রামীণ শাখায় ক্ষতি হবেই— এটা মেনে নিয়েই তাঁদের ব্যবসার কৌশল ঠিক করেছেন। কিন্তু বন্ধনের মতো সংস্থার কাছে ওটাই কাজ। ছাগল কেনার জন্য ঋণ দেওয়ার পরে সেই ঋণ যাতে উদ্ধারের অযোগ্য হয়ে না ওঠে, সেটা দেখা সংস্থার টিঁকে থাকার অন্যতম শর্ত। বড় ব্যাঙ্কের কাছে একটা বড় শিল্পপ্রকল্প যা, বন্ধনের কাছে ছাগলও তাই।

মাইক্রোফিনান্স সংস্থা টাকা ধার দেয়। অতিদরিদ্র মানুষরাও স্বাবলম্বনের পথে হাঁটতে পারেন, যদি এই সংস্থাগুলি দক্ষ ভাবে কাজ করে। কিন্তু টাকা জমানোর সংস্থা? ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় আবার টাকাও জমা নেয়। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষের মাথাপিছু সঞ্চয়ই বা কতটা, ঋণই বা কতটা করতে পারেন তাঁরা? বড় ব্যাঙ্কের ব্যবসার অঙ্কে তা পড়তায় পোষায় না। গ্রামীণ শাখা চালাতে বড় ব্যাঙ্কের কর্মী পিছু খরচ গড়ে ৭ লক্ষ টাকার ও বেশি। সেখানে মাইক্রোফিনান্স সংস্থা কর্মী পিছু ১ লক্ষ টাকা খরচেই শাখা চালাতে পারবেন। প্রথাগত ব্যাঙ্কের ব্যবসার অঙ্কে গ্রামীণ শাখা চালানো লাভজনক না হওয়ার ফল একটাই। স্বাধীনতার পরে ছয় ছয়টি দশক শেষ হওয়ার পরেও দেশের কৃষিনির্ভর পরিবারের ৭৫ শতাংশের কাছেই আইনি নিয়ন্ত্রণে থাকা আর্থিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

কিন্তু বাজার ফাঁকা থাকে না। ব্যাঙ্ক ছাগলের অঙ্ক মেলাতে পারে না, আর সেই সুযোগ মেনে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিয়ে ঋণ দিয়ে চলে গ্রামের শাইলকরা। যাঁরা কিছু সঞ্চয় করতে পারেন তাঁরা ঝোঁকেন সারদার মতো সংস্থার দিকে। ব্যাঙ্কে টাকা সুরক্ষিত জেনেও ব্যাঙ্কমুখো হতে পারেন না, কারণ তাঁদের ধারে কাছে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। সারদার মতো সংস্থা রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে মধ্য, পূর্ব আর উত্তর-পূর্ব ভারতে। ভারতে যে সমস্ত পরিবার আইনসম্মত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের বাস এই অঞ্চলেই।

যে দেশকে বলা হচ্ছে আগামী দিনের বৃহৎ আর্থিক শক্তি, তাকেও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা কী করে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা বুঝতে হচ্ছে বাংলাদেশ, কিনিয়া, অ্যাঙ্গোলার কাছে। ছাগল ধরার অঙ্কটা আগে শিখে ফেললে এই লজ্জাটা হয়তো পেতে হত না।

probondho suparna pathak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy