সাইবারভর। অদ্ভুত একটা নাম। শুনলেই একটু ভয় ভয় করে। মনে হয় সাইবারজগতের কোনও তান্ত্রিকের মারণ-বাণ গোছের কিছু হবে। না কি, সাইবারওয়ার্ল্ডে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ যদি সাইবার-ভূতে ভর করে, মাথার ডাক্তাররা তাকেই সাইবারভর বলেন?
ভূত বটে, তবে একটা নয়, প্রায় এক ডজন। ভূত বলেই হয়তো এদের কেমন দেখতে কেউ বলতে পারে না। শোনা যায় মঙ্গোলিয়া এবং কাজাকস্তান সংলগ্ন রাশিয়ার ছোট্ট একটা শহরে ঘাপটি মেরে রয়েছে এই সাইভরের দল... মাসখানেক আগের কথা। লাস ভেগাসের ব্ল্যাক হ্যাট সাইবার সিকিয়োরিটির কনফারেন্সে, ইন্টারনেট সুরক্ষার ক্ষেত্রে কর্মরত সংস্থা হোল্ড সিকিয়োরিটির অ্যালেক্স হোল্ডেন জানান, তাঁদের কাছে প্রমাণ রয়েছে যে, একশো কোটির বেশি ইউজার-নেম ও পাসওয়ার্ড চুরি করা হয়েছে ইন্টারনেট থেকে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা যে নামধাম ইত্যাদি রেজিস্ট্রার করে থাকি, সেগুলো নাকি খোয়া গেছে বস্তা বস্তা। চার লক্ষের বেশি যে সব ওয়েবসাইটের নাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে এই গোপন তথ্য হাপিস করা হল, তাদের মধ্যে কিছু নামকরা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইটও রয়েছে।
কারা করল এই কাজ? ঝড় উঠল ইন্টারনেটে, কাগজে, টেলিভিশনে। জানা গেল, রাশিয়ার এই হ্যাকারগোষ্ঠী Cybervor-এর কথা। রাশিয়ান ভাষায় ‘ভর’, বাংলায় চোর। এই সাইবার-চোরের দল খুব সহজেই গোটা পৃথিবীর ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বেকুব বানিয়েছে। এখন সংশয়, হাপিস করা এই পর্বতপ্রমাণ ডেটা নিয়ে কী দুষ্কর্ম করবে এরা? ব্যাংক থেকে টাকা ভ্যানিশ করে দেবে না তো? আমাদের ই-মেলে ঢুকে নেংটি পরা পার্সোনাল ছবি-টবি অনলাইন পোস্ট করে দেবে কি? না কি এই চোরাই ডেটাবেস ইন্টারনেটের কালোবাজারে সাধারণ লোক তাঁদের ওয়েবসাইটে গেলে জানতে পারবেন, তাঁদের ই-মেল পাসওয়ার্ড চুরি করা হয়েছে কি না, কোম্পানিদের অবশ্য পয়সা দিয়ে তা জানতে হবে। আর যে সব কোম্পানি জানতে পেরেছে যে তাদের ওয়েবসাইট থেকে ডেটাবেস চুরি গেছে, তারা ভাবছে এই বুঝি খদ্দেররা দোকান ছেড়ে পালায়। তার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির নাম ভাঁড়িয়ে ই-মেল করে নাম ঠিকানা পাসওয়ার্ড ব্যাংক ডিটেলস জেনে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া এখন নেট-চোরদের মধ্যে খুবই পপুলার, তার নাম দেওয়া হয়েছে ফিশিং (Phishing)। এই ফিশিং ই-মেল আমরা সকলেই কখনও না কখনও পেয়েছি। আফ্রিকান রাজার তেলের টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে, তোমাকে পাঠাতে চাই, বলে যে সুন্দর সব ই-মেল ইনবক্সে এসে হাজির হয়, তত ফেনিয়ে লেখা না হলেও ফিশিং ই-মেলের প্যাঁচ আরও মারাত্মক। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা ঠিকানায় গ্রামের নাম নেই এই রকম একটা চিমটি কেটে ফিশিং ই-মেল চেষ্টা করে ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, ঠিকানা, অ্যাকাউন্ট নম্বর, ক্রেডিট কার্ড ডিটেলস ইত্যাদি) ঝেড়ে দিতে। আর দিলেই অ্যাকাউন্ট সাফ, ক্রেডিট কার্ডে মঙ্গোলিয়া ছুটি কাটানোর বিল। অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানি ক্যাসপারস্কির জুন ২০১৩ হিসাব অনুযায়ী ভারতেই প্রতিদিন ১০,০০০ মানুষ ফিশিং ই-মেল পেয়ে থাকেন।
এ তো গেল চোর-ডাকাতের স্টোরি। কিন্তু ইন্টারনেটের চেনা বামুনরাই যখন মেতে ওঠে সাধারণ মানুষের প্রাইভেসি লঙ্ঘনের খেলায়, তখন ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যায় না কি? গুগ্ল-গ্লাসের কথা এত দিনে সবার কানেই পৌঁছেছে। চশমার ফ্রেমে লাগানো ছোট্ট যন্ত্র, তাতে স্মার্টফোনের যাবতীয় প্রযুক্তি, সঙ্গে অ্যানড্রয়েড সফটওয়্যার, ফোনের স্ক্রিনের বদলে এল-কস (LCos) ডিসপ্লে, যার ছবি সোজা এসে পড়ছে চোখের পর্দায়। চশমার সঙ্গেই ক্যামেরা চোখ টিপলে বা ‘টেক আ পিকচার’ বললেই সে স্টিল বা ভিডিয়ো তুলে নেবে। আবার ওই গুগ্ল-গ্লাস চোখে থাকা অবস্থায় বাঘের সানে পড়লে বাঘ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য তার বৈজ্ঞানিক নাম, পূর্বপুরুষদের খবর, খাদ্যাভ্যাস এমনকী রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বিষয়ক উইকিপেডিয়া আর্টিক্লটি চোখের সামনে ভেসে উঠবে।
এ বার এক কোম্পানি পরীক্ষামূলক ভাবে বাজারে এনেছে নেমট্যাগ অ্যাপ। এই নেমট্যাগেই রয়েছে শক্তিশালী ফেশিয়াল রেকগনিশান সফটওয়্যার, যা মুখ দেখে মানুষ চিনতে পারে। ব্যস, প্রাইভেসির টায়ার পাংচার! গুগ্ল-গ্লাসে নেমট্যাগ অ্যাপ ইনস্টল করা থাকলে যে কেউ রাস্তায় ঘাটে বারে বাজারে আপনার দিকে এক বার তাকিয়েই পেয়ে যাবে আপনার ঠিকুজি-কোষ্ঠী সব। এমনকী ফেসবুকের পাবলিক প্রোফাইল, ছবি, অন্যান্য অনলাইন তথ্য!
এই আলোচনা থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোকে বাদ দিলে আগরা গিয়ে তাজমহল না দেখে চলে আসা হবে। ফেসবুকের কথাই ভাবুন। এই সে দিনও কেউ কি স্বপ্নেও ভাবতে পারত যে ছোকরাছুকরি, বুড়োবুড়ি, কেরানি, কন্ডাক্টর, লেখক, গায়ক, সকলেই লাইন দিয়ে, নিজের জন্মদিনে দামি কোম্পানির কেক খাওয়া আর পুরীতে বেগুনি বারমুডা পরে নোনা জলে ডিগবাজি দেওয়ার অপূর্ব সব দৃশ্য বিশ্বের দরবারে হাজির করবে?
ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট আমাদের অনলাইন গতিবিধির উপর তীক্ষ্ন নজর রাখতে শুরু করেছে। ধরুন, রাতে বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে। সকালে উঠে আপনার স্মার্টফোনে নগেনের অনলাইন শপে গেরুয়া পাঞ্জাবিটা বেশ মনে ধরেছে। অফিসের তাড়ায় কেনা হয়ে ওঠেনি, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ খুলেই দেখেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কটি আপনার সাধু হওয়ার ইচ্ছে টের পেয়ে গেছে লাইন দিয়ে বিভিন্ন দামের গেরুয়া পাঞ্জাবি আপনার পাতায় কান ঘেঁষে নেচে বেড়াচ্ছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট আর নগেন অনলাইন শপ আপনার কেনা-বেচা, পছন্দ-অপছন্দের খবর নিজেদের মধ্যে চালাচালি শুরু করে দিয়েছে। এই বিপদ থেকে বাঁচতে চাইলে তৃতীয় একটা ওয়েবসাইটে গিয়ে নিজের নাম কাটিয়ে আসতে হয়। ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের এহেন কীর্তির বিরুদ্ধে অনলাইন পিটিশনে ইতিমধ্যে দেড় লক্ষ মানুষ সই করেছেন।
ফ্লোরিডা শহরের শিল্পী এক্সভালা (XVALA) তাঁর ‘ফিয়ার গুগল’ ক্যাম্পেনের অংশ হিসেবে ‘নো ডিলিট’ (No delete) নামে একটি প্রদর্শনী করতে চলেছেন। ‘ফিয়ার গুগ্ল’ অর্থাৎ গুগ্লাতঙ্ক। শোনা যাচ্ছে, সেখানে জেনিফার, কেট আপটনের আইক্লাউড থেকে চুরি যাওয়া এবং দুনিয়া জুড়ে শোরগোল তুলে দেওয়া ছবিগুলি প্রমাণ সাইজে এনলার্জ করে রাখা হবে।
তা হলে কি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না? না কি নিজেদের আরও সচেতন করে এই সব শক্তিশালী টেকনোলজির সঙ্গে মোকাবিলা করার রাস্তা এখনও খোলা আছে? ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy