অবশেষে তাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাবাত্রাকে বিদায় লইতেই হইল। এক উচ্চপদস্থ আমলাকে বছর তিনেক আগে বদলি করার দায়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার নয় জন মন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে বলিল দেশের এক সাংবিধানিক আদালত। তাঁহারা ইস্তফা দিয়াছেন। তবে আগামী জুলাই মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রী অন্তর্বর্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ চালাইবেন। তাইল্যান্ড আদালতের এই রায়ে সিনাবাত্রার বিরুদ্ধবাদীদের জয় হইয়াছে বলিয়া মনে হইতে পারে। তাঁহারা গত কয়েক বছর ধরিয়াই এই নির্বাচিত সরকারের ইস্তফার দাবিতে রাজধানী ব্যাংককের সব রাস্তা, সরকারি দফতর অবরুদ্ধ করিয়া চলিতেছিলেন। সিনাবাত্রার অপসারণে তাই তাঁহাদের উল্লসিত হওয়ার কথা। অচলাবস্থা সৃষ্টির আন্দোলন মারফত তাঁহারা যাহা করিতে পারেন নাই, আদালতের রায়ে তাহা কত অনায়াসে করা গেল। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর দল তাই ইহাকে এক ‘রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান’ও আখ্যা দিয়াছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও জুলাই মাসের নির্বাচনে পুনরায় ইংলাক সিনাবাত্রার দলেরই জয়ী হইবার সম্ভাবনা প্রবল। এই দলের মূল গণভিত্তি হইল উত্তরের প্রদেশগুলিতে ছড়াইয়া থাকা লক্ষ-লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ, চাষি, কারিগর। ‘লাল কুর্তা’ পরিয়া নিজেদের সমর্থন জাহির করা এই সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রী সিনাবাত্রার প্রতি সংহতি জানাইতে রাজধানীর বাহিরে পাল্টা সমাবেশও করিয়াছেন। তাঁহাদের প্রতিপক্ষ তাইল্যান্ডের মধ্য ও উচ্চবিত্ত সমাজ। এই দ্বন্দ্ব সহজে ঘুচিবার নয়। তাই সরকার ও বিরোধী পক্ষে সংঘাত চলিতেই থাকিবে। লাল-কুর্তাদের বিক্ষোভ যদি ‘হলুদ-জামা’ বিরোধীদের অবরোধের উপর আছড়াইয়া পড়ে, তবে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইবে, তাহা দমনের নামে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পথ সুপ্রশস্ত হইবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করিয়া সেনাবাহিনী পুনরায় তাইল্যান্ডকে সামরিক একনায়কত্বে ফিরাইয়া লইবার আশঙ্কা দেখা দিবে। অগ্রবর্তী অর্থনীতি, গণতান্ত্রিক বহুত্ব, খোলামেলা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সব মিলিয়া তাইল্যান্ড এক সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু বিগত আট বছর ধরিয়া থাকসিন সিনাবাত্রা ও তাঁহার দলের রাজনৈতিক উত্থান দেশের নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী মানুষের যে ক্ষমতায়ন ঘটায়, অভিজাতরা এবং শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি সেটা মানিয়া লইতে পারে নাই, হৃত আধিপত্য ফিরিয়া পাইতে কখনও সেনাবাহিনীকে, কখনও রাজতন্ত্রের ক্ষীয়মাণ মহিমাকে, সর্বশেষ বিচারবিভাগের কর্তাব্যক্তিদের ব্যবহার করিয়াছে।
তাইল্যান্ডে তদারকি সরকার কায়েম কিংবা নির্বাচনের মধ্য দিয়া নূতন শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থায়ী শান্তি ও প্রগতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাইল্যান্ডের পরিস্থিতির ক্রমাবনতি উদ্বেগের সহিত লক্ষ করিতেছে। হিংসা বা হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন যে কোনও আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যার মীমাংসা করিতে পারে না, আলাপ-আলোচনার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথই যে আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে, এই বিষয়টির উপর বারংবার জোর দেওয়া হইতেছে। বিরোধীরা ভোটে জিতিতে পারিবেন না বলিয়াই নির্বাচিত শাসক গোষ্ঠীকে নিরবচ্ছিন্ন হিংসাত্মক আন্দোলনে হেনস্থা ও হয়রান করিয়া চলিবেন, ইহা কোনও গণতন্ত্রে চলিতে পারে না। জনাদেশে গরিষ্ঠতা হাসিল করা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে শাসক হিসাবে শিরোধার্য করাই গণতন্ত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy