যখন প্রায় পৌনে দুই লক্ষ মানুষ শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তার সন্ধান করেন এবং তাঁহাদের অধিকাংশই মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ— যুবাপুরুষরা সকলেই বাস্তু ও আবাদ পাহারা দিতে তির-ধনুক-তরবারি লইয়া রহিয়া গিয়াছেন— তখন বুঝা যায়, পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে। অসমে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে স্থিত বড়োলা্যান্ডের মিশ্র জনপদগুলি সংবিজিত্ গোষ্ঠীর বড়ো জঙ্গিদের গণহত্যায় আজ এমনই বৈরিতায় আক্রান্ত। এই বৈরিতা জনজাতীয়। বড়োরা যেমন জনজাতি, তাহাদের সর্বশেষ হামলার লক্ষ্য আদিবাসীরাও তেমনই। আদিবাসীদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা দেড়শত বছর আগে চা-বাগানে মজদুরি করিতে পূর্ব ভারত হইতে আনাইয়া বসত করায়। আর বড়োরা পশ্চিম হইতে অভিবাসী হইয়া এখানে বসতি করিয়াছিলেন। উভয় জনগোষ্ঠীই মূলত কৃষিজীবী, একসঙ্গে জঙ্গল হাসিল করিয়া চাষযোগ্য জমি তৈয়ার করিয়াছেন। মোটামুটি শান্তিতে সহাবস্থানের ঐতিহ্যই তাঁহাদের বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু এ কালে জনজাতীয় আত্মশাসনের দাবির খণ্ডিত মীমাংসা মাঝেমধ্যেই বড়ো জঙ্গিদের উগ্রতর অংশটিকে সন্ত্রাসে প্ররোচিত করে।
বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক স্বশাসিত সংস্থার কর্তৃত্ব কাহার হাতে থাকিবে, কোন গোষ্ঠী প্রশাসন পরিচালনার নেতৃত্ব দখল করিবে, তাহা লইয়া জঙ্গিদের মধ্যে কাজিয়া পুরানো। উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতীয় স্বশাসনের আন্দোলনে বার বারই দেখা গিয়াছে, সরকার কোনও একটি গোষ্ঠীর সহিত আপসরফায় উপনীত হইলে, অন্য গোষ্ঠী উগ্রতর হিংসার আশ্রয় লইয়া নিজেদের দরকষাকষির শক্তি জানান দেয়। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, অসম, সর্বত্রই একই চিত্র। পশ্চিমবঙ্গে গোর্খা আঞ্চলিক স্বশাসনের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়াছে, সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ-কে কালক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া বিমল গুরুঙ্গদের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা স্বশাসনের আন্দোলনের পালের হাওয়া কাড়িয়া লইয়াছে। বড়োল্যান্ডে সংবিজিত্ গোষ্ঠীর জঙ্গিরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে বিশেষ পাত্তা না পাইয়া অস্তিত্ব জাহির করিতে থাকিয়া থাকিয়াই এমন সন্ত্রাস সংঘটিত করিয়া থাকে। এই জঙ্গিদের যে দমন করা যায় না, তাহার কারণ স্বশাসিত পরিষদগুলিকে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কিছুতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার সঁপিতে চায় না। এই দায়িত্বটি নিজেদের হাতে রাখিয়া দেওয়ায় স্বশাসিত প্রশাসন জঙ্গি মোকাবিলায় ঠুঁটো হইয়া থাকে।
কিছু কাল আগে বড়োল্যান্ড প্রশাসনের প্রতিনিধিদল এই দাবিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে স্মারকলিপি দিয়াছিল। তাহার কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও নাই। স্বশাসিত এলাকাগুলির বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও কেন্দ্র সহসা মঞ্জুর করিতে চাহে না। রাজ্য সরকারের পীড়াপীড়িতে সেই তহবিলও রাজ্যের হাত দিয়াই একটু-একটু করিয়া স্বশাসিত প্রশাসনের হাতে দেওয়া হয়। ক্ষমতা ও তহবিলের যে-বিকেন্দ্রীকরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সার, তাহা কিছুতেই ক্ষমতাশীলরা বুঝিতে চাহে না। কেন্দ্রের সহিত দরকষাকষির সময় রাজ্যের আর্থ-রাজনৈতিক অধিকার লইয়া আন্দোলনমুখর হইলেও একই অধিকার স্বশাসিত প্রশাসনগুলিকে মঞ্জুর করার প্রশ্নে রাজ্য সরকারগুলি যত্পরোনাস্তি কৃপণ। বড়োল্যান্ডের সর্বশেষ হিংসার কৃষ্ণমেঘে একটিই সুলক্ষণ: রূপালি রেখার আভাস দেখা যাইতেছে আদিবাসী ও বড়ো উভয় জনগোষ্ঠীর তরুণ সম্প্রদায়, বিশেষত ছাত্রনেতারা কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া একসঙ্গে পারস্পরিক অনাস্থা দূর করা, ত্রাণশিবিরে পরস্পরের দেখাশোনা করা, খোঁজখবর লওয়া এবং সুষ্ঠু, পক্ষপাতমুক্ত ত্রাণসামগ্রী বণ্টনে ব্যাপৃত। দুই জনগোষ্ঠীর বিভাজন যাহাতে শত্রুতায় পরিণত না-হয়, সেই লক্ষ্যে তাঁহারা সক্রিয়। সন্ত্রাসবাদী নেতৃত্বের প্রতি তাঁহাদের ধিক্কার ও প্রত্যাখ্যানও বড়োল্যান্ডে শান্তি ও স্থিতি ফিরাইতে সক্ষম হইতে পারে।