Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

সততা ভাল, কিন্তু চাই স্বচ্ছ সবল সুচিন্তাও

কেবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ-মৌলবাদ এবং তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে স্লোগান দিয়ে লোকেদের আস্থা ফেরানো যায়? পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের কথাটা ভাল করে ভেবে দেখা দরকার।বামপন্থা, বিশেষত মার্ক্সবাদ সম্পর্কে যখন বিশ্ব জুড়ে নতুন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে (বাজারের মাপকাঠিতেই যার হিসেব পাওয়া যায় মার্ক্সের লেখাপত্রের রাশি রাশি পুনর্মুদ্রণে) তখন পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ বামপন্থী ঐতিহ্যে ঠিক কী কারণে ক্ষয়ের লক্ষণ? পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত রাজনৈতিক ঘোষণা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বলেছিল, ‘মানুষের বস্তুগত অস্তিত্বের পরিবর্তন তার সামাজিক সম্পর্ক ও জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণাগুলোর, এক কথায় তার চৈতন্যের পরিবর্তন ঘটে।’

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বামপন্থা, বিশেষত মার্ক্সবাদ সম্পর্কে যখন বিশ্ব জুড়ে নতুন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে (বাজারের মাপকাঠিতেই যার হিসেব পাওয়া যায় মার্ক্সের লেখাপত্রের রাশি রাশি পুনর্মুদ্রণে) তখন পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ বামপন্থী ঐতিহ্যে ঠিক কী কারণে ক্ষয়ের লক্ষণ? পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত রাজনৈতিক ঘোষণা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বলেছিল, ‘মানুষের বস্তুগত অস্তিত্বের পরিবর্তন তার সামাজিক সম্পর্ক ও জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণাগুলোর, এক কথায় তার চৈতন্যের পরিবর্তন ঘটে।’ ঠিক কোন পরিবর্তনগুলো পশ্চিমবঙ্গের চেতনায় বামপন্থা বিষয়ে নিস্পৃহতা গড়ে তুলল, এর উত্তর খোঁজার বিভিন্ন প্রচেষ্টার মধ্যেই হাতে এল সম্প্রতি প্রকাশিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি প্রবন্ধ সংকলন। বিশ্বের বামপন্থী ঐতিহ্যটাই গড়ে উঠেছে লিপিবদ্ধ বিশ্লেষণী আলোচনা এবং বিতর্কের মধ্য দিয়ে। একদা ভারতীয় বামপন্থী ধারাও এই ঔজ্জ্বল্যে দ্যুতিমান ছিল। এমন নয় যে, সকলেই পি সি জোশী, সোমনাথ লাহিড়ী, অশোক মিত্রদের মতো সুলেখক ছিলেন, কিন্তু চিন্তার একটা সচল ধারা লিপিবদ্ধ হয়ে থেকেছে বহু দিন। এমনকী তর্কের খাতিরে তর্ক করতে গিয়েও অনেক বামপন্থী চিন্তাচর্চার বৃহৎ ক্ষেত্রটিতে প্রভূত অবদান রেখেছেন। যেমনটা করেছেন, সম্পূর্ণ অন্য ক্ষেত্রে, প্রাক্-ঔপনিবেশিক কালের ন্যায়শাস্ত্রের আলোচকরা। বঙ্গীয় তর্কধারা, মার্ক্সীয় বস্তুবাদী বিশ্লেষণের পথ ধরে, বিদ্যাচর্চায় একটা অন্য মাত্রাও বোধহয় যোগ করেছে।

অধুনা সেই ধারা ক্ষীণ হতে হতে ফল্গু। এই আকালেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য লিখে থাকেন। তাঁর প্রবন্ধগুচ্ছ, এবং তা বেরোচ্ছে বামফ্রন্টের ক্ষমতাচ্যুতির সাড়ে তিন বছর পর। স্বাভাবিক আগ্রহে বইটা দু’বার পড়া গেল, প্রথম বার কী আছে দেখবার জন্য এবং দ্বিতীয় বার, প্রথম বারের পড়াটা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য। পাশাপাশি, ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলোও মিলিয়ে দেখলাম— মার্ক্সবাদী বলে পরিচিত নেতাদের লেখাপত্রে প্রায়শই প্রচুর ভুলভাল উদ্ধৃতি চোখে পড়ে, এ বই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এটা খুবই লক্ষ করার মতো যে, ব্যস্ত দিবারাত্রির মধ্যেও বুদ্ধদেববাবু এত বইপত্র পড়ার সময় বার করতে পারেন। বিশ্ব পৃথিবীর, বিশেষত সাহিত্য বিষয়ে তাঁর ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা, বিশ্ব রাজনীতির হাল-হকিকত নিয়ে তাঁর খবর রাখাও রীতিমত লক্ষণীয়। কিউবার সামাজিক অগ্রগতি নিয়ে মুগ্ধ, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিতে নারী এবং সমাজের সকল স্তরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে চমৎকৃত, চিনের সমাজতন্ত্রে বাজারের ভূমিকা বিষয়ে আশাবান এই লেখক সত্তরের দশকে চিলিতে ফ্যাসিবাদী শাসন বা নাৎসি জার্মানির ইতিহাস ঘাঁটছেন, ফিরে দেখছেন ভারতীয় নৌ-বিদ্রোহকে। নৈতিক দর্শনের কিছু মৌলিক বিতর্ক— যেমন ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব নিয়ে তিনি আগ্রহী, আবার ভাবছেন একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও। সাহিত্য আলোচনায় ঘুরে আসেন রবীন্দ্রনাথ, মানিক, জীবনানন্দ, সমরেশ হয়ে মায়াকোভস্কি, কামু, গুন্টার গ্রাস থেকে গার্সিয়া মার্কেস। বাংলা থিয়েটারে বিদেশি নাটকের প্রভাবও তাঁর চর্চার অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের কলেজ-ইউনিভার্সিটি শিক্ষার সুযোগলব্ধ একাংশের মধ্যে ব্যক্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাঠোৎসাহী, সাহিত্যপ্রেমী, সংস্কৃতিমনা যে পরিচিতিটি নির্মিত হয়ে এসেছে, এই সংকলন সে ছবিটাকেই নিরাপত্তা দেয়।

সমস্যা হল, ব্যক্তিগত ঝোঁক যা-ই হোক না, সাধারণ পাঠক তো জননেতার (স্ব)নির্বাচিত প্রবন্ধে জনপরিসরের জরুরি ব্যাপারগুলো নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ দাবি করবে। সেই বিচারে, না বলে উপায় নেই, লেখাগুলো পড়ে যে-শিক্ষা পাওয়া গেল, সেটা খুব কার্যকর কিছু নয়। এই মুহূর্তটা হল জরুরি কর্তব্য সম্পাদনের, সে বিষয়ে দিশা খোঁজার মুহূর্ত, সাহিত্য ও পূর্বধারণায় আচ্ছন্ন গত-বাঁধা রাজনীতিতে স্বাচ্ছন্দ্য সন্ধানের নয়। রাজ্যের বামপন্থী জনসাধারণ এখনও সংখ্যায় এবং চারিত্রগুণে নগণ্য হয়ে পড়েননি, বিপর্যয় থেকে নবোদিত হওয়ার যে-পথ তাঁরা খুঁজছেন, তার দিশা যদি এমন মুহূর্তে প্রকাশিত বইটি না দিতে পারে, তা হলে বাম জননেতার সত্তাটিই যে কুয়াশায় ঢেকে যায়!

ছোট-বড় কুড়িটি প্রবন্ধের যে দশটি রাজনীতি বিষয়ক, তাতে পশ্চিমবাংলার কথা আড়াই পাতায় সারা। তা-ও কেবল আত্মবন্দনা। আন্তর্জাতিকতা মার্ক্সবাদের একটা মূল ব্যাপার, কিন্তু স্থান-কালের নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণটাও তো তার ভিত্তি। নির্বাচিত প্রবন্ধ সে-পথ মাড়ায় না। আরও আশ্চর্য, ২০১১-র বিপর্যয়ের পর শ্রীভট্টাচার্য যে-পাঁচটি লেখা লিখেছেন, তার চারটিই সাহিত্য বিষয়ক: মাত্র একটি রাজনীতি নিয়ে, যা আবার একুশ শতকের সমাজতন্ত্র বিষয়ে একটি সাধারণ পরিক্রমা। অথচ, লোকে তাঁর কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ এবং ঘোরতর সমস্যা নিয়ে চিন্তানুশীলন প্রত্যাশা করছে। সে আশা পূরিত না হলে লোকে যদি আস্থা হারায়, তা হলে তাদের ‘বিভ্রান্ত’ চিহ্নিত করার দলীয় প্রথাটা পরিচিত। কিন্তু, কেবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ-মৌলবাদ ও তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে স্লোগান দিয়ে লোকেদের আস্থা ফেরানো যায়?

বামপন্থীদের পর্যুদস্ত হওয়ার কারণ নিয়ে তিন জন চিন্তানুশীলক অশোক মিত্র, অমর্ত্য সেন ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই পত্রিকায় অদূর অতীতে আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের কথা থেকে একটা সাধারণ ধারা বেরিয়ে এসেছে: বামপন্থীদের স্বচ্ছ চিন্তার অভাবই এই শক্তিহীনতার প্রধান কারণ। আলোচ্য সংকলনে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলোর বাছাই নিয়ে অস্বচ্ছতার কথা আমরা উল্লেখ করেছি: ঠিক কোন কারণে বিশেষ একটি মুহূর্তের দাবি অগ্রাহ্য করে তিনি ‘সাধারণ’-এর শরণাপন্ন হলেন, তার কোনও ব্যাখ্যাও যে তিনি দিলেন না, এটা কি তাঁর ব্যক্তিগত ঝোঁক, না কি দলীয় স্নায়ুবদ্ধ চিন্তাহীনতার অভ্যাস প্রশিক্ষণের ফল?

তাঁর বলা কথাগুলোও অনেক সময় চিন্তার বিক্ষিপ্ত প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে যথাযথ কারণেই আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, “সব ধর্মেরই শেষ প্রার্থনা ধর্মে ধর্মে মিলন, মানবিকতা।” মার্ক্সীয় ব্যাখ্যা না হয় বাদই দিলাম, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও কি তা-ই বলে? ‘সব ধর্মেরই সারাংশ’ যদি হয় ‘বিবাদ নয়— সহায়তা, বিনাশ নয়— গ্রহণ, মতবিরোধ নয়— সমন্বয় ও শান্তি’, তা হলে ‘নাস্তিকতার কোনও বিকল্প নেই’ দাবিটা করা কেন?

রাজ্যে তিন দশকের বেশি বাম শাসনের পরও নিরক্ষরতাটাই দূর করতে না-পারা; স্বাস্থ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে সেই ‘নয়া উদারনীতিবাদী’ পিপিপি ও এসইজেড অনুসরণ, যে নীতিকে গাল না পেড়ে বক্তৃতা শুরু বা শেষ হয় না; দক্ষিণ আফ্রিকার পার্টিতে নারী ও অন্যান্যদের প্রতিনিধিত্ব দেখে উৎফুল্ল হওয়া, কিন্তু এ রাজ্যে সে প্রতিনিধিত্ব দশ শতাংশেও পৌঁছতে না পারা— যে সব বৈশিষ্ট্য এ রাজ্যে বাম নীতির পরাকাষ্ঠা, দলীয় কেন্দ্রীকরণ তাদের আর এক রূপ। এ সমস্যাগুলো কেবল ব্যক্তিগত সততা দিয়ে দূর করা যায় না, তাদের গভীর ভাবে অনুধাবন করাটা মার্ক্সের ব্যক্তিগত জীবনচর্যার ও শিক্ষা: ক্যাপিট্যাল সম্পূর্ণ না করে তিনি যে জীবনের শেষ পনেরো বছর পৃথিবীর বিভিন্ন, বিশেষত প্রাচীন জনসম্প্রদায় বিষয়ে অনুসন্ধানে মগ্ন ছিলেন, সেটা তো তাঁর বৈজ্ঞানিক মননেরই পরিচালনায়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র নতুন জার্মান সংস্করণের (১৮৯০) মুখবন্ধে এঙ্গেলস মার্ক্সের ‘শ্রমিক শ্রেণির মননগত বিকাশের উপর’ একান্ত নির্ভরতার যে-কথা বলেছিলেন, এবং ‘ঐক্যবদ্ধ কর্মকাণ্ড ও আলোচনা’র উপর তাঁর যে জোর-এর উল্লেখ করেছিলেন, সেই সামূহিক চিন্তানুশীলনের জরুরি কাজটা তো আজও ততটাই সত্য, যতটা ছিল উনিশ শতকের শেষে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থা এটাকে বাহুল্য বা অ-প্রাথমিক কর্তব্য বলে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যার ফলে আমরা পড়ি শ্রীভট্টাচার্যের প্রশ্ন: ‘মানুষের হতে চাওয়া, এবং হওয়া, সবটাই কি মানুষের নিয়ন্ত্রণে?’

নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এই অ-নিয়ন্ত্রণের কাছে আত্মসমর্পণটাও মার্ক্সবাদ তো নয়ই, সাধারণ মানবিক চিন্তাতেও এর অনুমোদন নেই। বিশ্ব বামপন্থা ‘হওয়া’ এবং হওয়ার জন্য ‘করা’র অনুশীলনেই সমৃদ্ধ হয়েছে; ভুল করেছে, ভুলের কারণ খুঁজেছে এবং অগ্রবর্তী হয়েছে— চিন্তার সবলতায়। শ্রীভট্টাচার্য ও তাঁর দলের এ কাজে মনোনিবেশের সুযোগ আছে। এখনও।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচিত প্রবন্ধ, পরিবেশক: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kumar rana buddhadeb bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE