Advertisement
E-Paper

সন্তান ১, মা-বাবা ৩

টেস্ট টিউব বেবি দিয়ে যে বিপ্লবের শুরু, এ বার তার এক নতুন পর্ব রচিত হল। এবং, এ বারও, আমেরিকাকে হারিয়ে দিল ইংল্যান্ড।সাঁইত্রিশ বছর আগে এক বিপ্লব হয়েছিল চিকিত্‌সাবিজ্ঞানে। ইংল্যান্ডে। বিবাহিতা মহিলা লেসলি ব্রাউন সন্তান চান। কিন্তু তাঁর গর্ভে ভ্রূণ ধারণে বিপত্তি। এ সমস্যা বহু পুরনো। এর শিকার লক্ষ লক্ষ মহিলা। সবার রোগ এক নয়। লেসলির ব্যাধি ফ্যালোপিয়ান টিউব-সংক্রান্ত। এ হল সেই নল, যে পথে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু জরায়ুতে গিয়ে পৌঁছয়। তার সঙ্গে পুরুষের শুক্রাণুর মিলনে তৈরি হয় ভ্রূণ।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০২

সাঁইত্রিশ বছর আগে এক বিপ্লব হয়েছিল চিকিত্‌সাবিজ্ঞানে। ইংল্যান্ডে। বিবাহিতা মহিলা লেসলি ব্রাউন সন্তান চান। কিন্তু তাঁর গর্ভে ভ্রূণ ধারণে বিপত্তি। এ সমস্যা বহু পুরনো। এর শিকার লক্ষ লক্ষ মহিলা। সবার রোগ এক নয়। লেসলির ব্যাধি ফ্যালোপিয়ান টিউব-সংক্রান্ত। এ হল সেই নল, যে পথে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু জরায়ুতে গিয়ে পৌঁছয়। তার সঙ্গে পুরুষের শুক্রাণুর মিলনে তৈরি হয় ভ্রূণ। যা পরে মানবশিশু। লেসলির ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজ। মানে, ওই নল অপরিসর। ডিম্বাণুর চলায় বাধা। তা পৌঁছচ্ছিল না জরায়ুতে। লেসলি গর্ভবতী হতে পারছিলেন না। বিয়ের ন’বছর পরেও।

লেসলি এবং তাঁর স্বামী জন ব্রাউন-এর হতাশা দূর হল দু’জনের চেষ্টায়। রর্বাট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটো। কন্যাসন্তানের মা হলেন লেসলি। কী ভাবে? যে কাজটা হওয়া উচিত ছিল লেসলির গর্ভে, তা ওই দুই চিকিত্‌সক করলেন টেস্ট টিউবে। লেসলির ডিম্বাশয় থেকে সরাসরি ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হল। তার সঙ্গে লেসলির স্বামীর শুক্রাণুর মিলন ঘটানো হল টেস্ট টিউবে। মিলল ভ্রূণ। তা স্থাপন করা হল লেসলির গর্ভে। যথাসময়ে জন্মাল লুইজ ব্রাউন। বিশ্বে প্রথম টেস্ট টিউব বেবি। আমেরিকাকে পিছনে ফেলে ইংল্যান্ডের সাফল্য। হতাশ বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে পৃথিবীতে এখন জন্মায় লক্ষ লক্ষ এমন শিশু। ২০১০ সালে চিকিত্‌সাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এডওয়ার্ডস। স্টেপটো প্রয়াত ১৯৯৮-এ। নয়তো পুরস্কৃত হতেন তিনিও।

সাঁইত্রিশ বছর পরে আরও এক বার আমেরিকাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড। সন্তানধারণ প্রক্রিয়ায় নতুন কৌশলের সবুজ সংকেত দিল ওই দেশ। কৌশলটি বৈপ্লবিক। টেস্ট টিউব বেবির জন্মলাভে একদা শুরু হয়েছিল যে নতুন যুগ, তার অগ্রগতিতে বিরাট এক পদক্ষেপ। টেস্ট টিউব প্রক্রিয়ায় কেবল মায়ের ডিম্বাণু আর বাবার শুক্রাণু মিলনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটানো হয় মাতৃদেহের বাইরে। সন্তান লাভের মূলে এক জন বাবা ও এক জন মায়ের অবদান থাকে অটুট। নতুন যে কৌশলের ছাড়পত্র দিল ইংল্যান্ড, তাতে ওই অবদানের চিরাচরিত ধারাটিই গেল পালটে। শুধু মা-বাবা, এ-দু’জন নয়, সন্তানের জন্মের পিছনে প্রয়োজনে ভূমিকা থাকবে আরও এক জনের। অর্থাত্‌, সন্তানের অংশীদার হবে তিন জন। জন্মাবে থ্রি-পেরেন্ট বেবি।

বাবার শুক্রাণু আর মায়ের ডিম্বাণু মিলে যদি শিশুর ভ্রূণ, তবে আর তৃতীয় ব্যক্তির অবদানের সুযোগ কোথায়? হ্যঁা, আছে। টেস্ট টিউব বেবি যেমন একটা সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়, থ্রি-পেরেন্ট বেবিও তাই। সমস্যা এ ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভধারণে বাধা নয়, এমন সন্তান গর্ভে ধারণ, যার অকালমৃত্যু বা রোগজর্জর জীবন অনিবার্য। সে সব ব্যাধি কুরে কুরে খায় নানা অঙ্গ। স্নায়ুতন্ত্র, পেশি, চোখ, হৃত্‌পিণ্ড, পাকস্থলি, যকৃত্‌, কান-গলা-নাক ইত্যাদি। এত সব অঙ্গের কাজে নানা রকম বিঘ্ন। কিংবা পুরোপুরি ব্যর্থতা। পরিণাম? সন্তান হয়তো জন্মাল ঠিকঠাক। বয়েস বছর না গড়াতেই দেখা গেল সে হাত-পা নাড়াতে পারে না, পেশি অবশ, কানে শোনে না, ক্রমে চোখে দেখে না। অথবা তার হৃত্‌পিণ্ড কর্মক্ষম নয়। শিশুর আয়ু চার-পাঁচ বছর গড়ায় না।

রোগ হরেক রকম। কিন্তু সবগুলোই জন্মসূত্রে পাওয়া। অর্থাত্‌ জিনঘটিত। রোগের উত্‌স শিশুর দেহকোষের বিশেষ এক উপাদান। মাইটোকনড্রিয়া। যা থাকে কোষের সব থেকে বড় উপাদান নিউক্লিয়াসের বাইরে। জীবদেহের মুখ্য ব্লু-প্রিন্ট হল তার কোষের নিউক্লিয়াসের বাসিন্দা ডিএনএ বা জিন। ওই বস্তুটা নির্ধারণ করে তার আকার, আয়তন। প্রায় ২৩,০০০ জিন থাকে নিউক্লিয়াসের ডিএনএ-তে। মজার ব্যাপার, জীবকোষে ডিএনএ-র আস্তানা কেবল নিউক্লিয়াস নয়, ওই যে মাইটোকনড্রিয়া, তার মধ্যেও থাকে সামান্য ডিএনএ। মাত্র সাঁইত্রিশটা জিন। সংখ্যায় নগণ্য হলেও, ওই হাতে-গোনা জিন নিয়েই মাইটোকনড্রিয়া রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় জীবকোষে। হবেই, কারণ নিউক্লিয়াসের বাইরে থেকেও মাইটোকনড্রিয়া যে কোষের পাওয়ার হাউস। নানা কাজ করতে কোষের চাই এনার্জি। যেমন, মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ কোষ। সেখানে একে অন্যের সঙ্গে সংকেত দেওয়া-নেওয়া। অথবা দেহের দূরবর্তী কোনও কোষকে নির্দেশ পাঠাবে মস্তিষ্ক। তো এই সব কাজে চাই এনার্জি। চলতে-ফিরতে, দাঁড়িয়ে থাকতে, বা ওজন তুলতেও মাংসপেশির চাই এনার্জি। তার জোগান দেবে কে? ওই মাইটোকনড্রিয়া।

নিজের পেটে ডিএনএ থাকায় মাইটোকনড্রিয়া নিজেই যেন একটা কোষ। তার বাসা আবার জীবকোষে। মানে, কোষের মধ্যে কোষ। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, কোটি কোটি বছর আগে মাইটোকনড্রিয়া আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করত। প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে এক সময় ঢুকে পড়েছে অন্য কোষের মধ্যে। তাতে দুইয়ের লাভ: নিজে যেমন টিকে থেকেছে, তেমনই আশ্রয়দাতা কোষেরও মঙ্গল করেছে তার নানা কাজ করার জন্য এনার্জি জুগিয়ে।

এ হেন গুরুত্বপূর্ণ যার ভূমিকা, সেই মাইটোকনড্রিয়া তা পালনে ব্যর্থ হলে জীবকোষের অমঙ্গল। সন্তানের যে সব দুরারোগ্য ব্যাধির কথা বলেছি, তা মাইটোকনড্রিয়ার ওই মাত্র সাঁইত্রিশটা জিনের ভুল কাজের পরিণাম। জিন ভুল কাজ করে, যখন কোনও কারণে তার গঠন পালটায়। এখানে প্রাসঙ্গিক আর এক তথ্য। বাবার শুক্রাণু আর মায়ের ডিম্বাণু, এ দুইয়ের মধ্যেই মাইটোকনড্রিয়া থাকলেও, দুইয়ে মিলে যখন ভ্রূণ তৈরি হয়, তখন তার মধ্যে টিকে থাকে কেবল ডিম্বাণুরই মাইটোকনড্রিয়া। ভ্রূণ থেকেই যেহেতু মানুষ, তাই প্রত্যেকের দেহকোষে উপস্থিত মাইটোকনড্রিয়া তার মায়ের উপহার, বাবার নয়। মাইটোকনড্রিয়া-ঘটিত রোগ, সুতরাং, মাতৃদত্ত। এবং বংশানুক্রমে প্রাপ্ত।

কালান্তক রোগ থেকে শিশুকে বাঁচাতেই তিন মা-বাবার সন্তান প্রযুক্তি। দুই মা ও এক বাবার সন্তান। গর্ভধারিণী মা (যাঁর মাইটোকনড্রিয়া বিপজ্জনক)-এর ডিম্বাণু থেকে মাইটোকনড্রিয়া বাদ দিয়ে বাকি অংশ, অন্য এক মহিলার ডিম্বাণু থেকে শুধু মাইটোকনড্রিয়া এবং বাবার শুক্রাণু এই তিনের মিলনে ভ্রূণ তৈরি।

এই প্রযুক্তি চালুর দাবিতে চিকিত্‌সাবিজ্ঞানীরা সরব বহুকাল। তবে আপত্তি অনেকের। ভ্রূণ নিয়ে কারিকুরি যাঁদের চক্ষুশূল, যাঁরা মনে করেন পছন্দমাফিক সন্তান কিংবা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বানানোর ফন্দি ওই কারিকুরি, সেই সব ধার্মিক এবং নীতিবাগীশেরা প্রবল আপত্তি তুলছিলেন তিন মা-বাবার সন্তান প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। সে আপত্তি টিকল না ইংল্যান্ডে। পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে সবুজ সংকেত পেল ওই প্রযুক্তি। পক্ষে: ৩৮২। বিপক্ষে: ১২৮। আমেরিকায় কিন্তু ওই প্রযুক্তি এখনও আইনত নিষিদ্ধ। ওখানে চিকিত্‌সাবিজ্ঞানীরা আশায় দিন গুনছেন, কবে তিন মা-বাবার সন্তান প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়ার ছাড়পত্র পাবেন।

ইংল্যান্ড তিন মা-বাবার সন্তানে সবুজ সংকেত দেওয়ায় রীতিমত উত্‌ফুল্ল ব্রিটিশ মহিলা হানা স্মিথ। সাতাশ বছর বয়সী হানা ‘মেলাস সিনড্রোম’-এর শিকার। তিনি দেহকোষে বহন করছেন বিপজ্জনক মাইটোকনড্রিয়া। নিজে অসুস্থ নন, কিন্তু তাঁর সন্তানের ডায়াবিটিস, বধিরত্ব এবং মৃগী রোগ অবশ্যম্ভাবী। হানা বলেছেন, ‘বড় ভাল সময়ে নতুন প্রযুক্তি আসছে। আমার সন্তান হলে, তার জীবন হবে নীরোগ। তারও সন্তান হবে সুস্থ, স্বাভাবিক।’

anandabazar post editorial pathik guha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy