Advertisement
E-Paper

সমাজ ও একটি মেয়ে

মেয়েটির বয়স হইয়াছিল মাত্র তেরো বৎসর। যে বয়সে মেয়েরা নবাগত বয়ঃসন্ধির স্বাদগন্ধ উপভোগ করিতে আরম্ভ করে মাত্র, হায়দরাবাদের আরাধনা সমদরিয়া সেই বয়সেই টানা দশ সপ্তাহ উপবাস করিল। উপবাসান্তে বিপুল উৎসব হইল, রাজ্যের মন্ত্রী-নেতারা উপস্থিত থাকিয়া মেয়েটির সঙ্গে ছবি তুলিলেন।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৯

মেয়েটির বয়স হইয়াছিল মাত্র তেরো বৎসর। যে বয়সে মেয়েরা নবাগত বয়ঃসন্ধির স্বাদগন্ধ উপভোগ করিতে আরম্ভ করে মাত্র, হায়দরাবাদের আরাধনা সমদরিয়া সেই বয়সেই টানা দশ সপ্তাহ উপবাস করিল। উপবাসান্তে বিপুল উৎসব হইল, রাজ্যের মন্ত্রী-নেতারা উপস্থিত থাকিয়া মেয়েটির সঙ্গে ছবি তুলিলেন। তাহার পর, মেয়েটি মারা গেল। উপবাসের ফলে শরীরে জলীয় পদার্থের ঘোর অভাব হয়। পরিণাম: হৃদরোগ ও মৃত্যু। উপবাস জৈন ধর্মের একটি প্রচলিত প্রথা, কিন্তু কে কত দিন উপবাস করিবেন, তাহা ব্যক্তিবিশেষের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। আরাধনা কেন এত দীর্ঘ দিন উপবাস করিল, তাহা লইয়া তর্ক চলিতেছে। কোনও এক ধর্মগুরু নাকি তাহার পিতাকে পরামর্শ দিয়াছিলেন, মেয়ে উপবাস করিলে পরিবারের আর্থিক সংকট কাটিবে। পরিবারের পক্ষ হইতে অবশ্য দাবি, আরাধনা স্বেচ্ছায় উপবাস করিতেছিল। পরামর্শটি প্রত্যক্ষ কারণ হইতে পারে, একমাত্র কারণ ভাবিলে ভুল হইবে। একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ‘স্বেচ্ছায়’ এত দিন উপবাসের অধিকার দেওয়া যায় কি না; পরিবার যদি আপত্তি না করে, রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করিতে পারে কি না; রাষ্ট্র যদি ইরম শর্মিলাকে খাদ্যগ্রহণে বাধ্য করিতে পারে, এই মেয়েটির ক্ষেত্রেই বা নহে কেন; আত্মহত্যা যদি বেআইনি হয়, ধর্মীয় কারণে আত্মহত্যাই বা নহে কেন— প্রতিটি প্রশ্নই জরুরি। প্রায়োপবেশন ও আত্মহত্যার দার্শনিক সীমারেখা কোথায়, তাহাও তাত্ত্বিকদের অনন্ত তর্কের বিষয় হইতে পারে। কিন্তু যে উপবাস মৃত্যুর কারণ, আইন তাহাকে কেন আত্মহনন হিসাবেই দেখিবে না, জরুরি সেই প্রশ্নও।

কিন্তু আরও জরুরি বৃহত্তর সমাজের বিচারবুদ্ধিকে প্রশ্ন করা, যে সমাজ একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের দশ সপ্তাহব্যাপী উপবাসকে উৎসবে পরিণত করিতে পারে। আরাধনার মৃত্যুর পর সমালোচনার ঝড় বহিয়াছে। তাহার পিতা-মাতার বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করিয়াছে। আরাধনার পিতা বিস্মিত প্রশ্ন করিয়াছেন, সে দিন যাঁহারা উৎসবে শামিল হইয়াছিলেন, তাঁহারাই আজ অন্য কথা বলিতেছেন কেন? কারণটি সহজ। আরাধনা যত ক্ষণ জীবিত ছিল, তত ক্ষণ অবধি তাহার জীবন অপেক্ষা ধর্মীয় প্রথার প্রতি তাহার আনুগত্যের মহিমা অনেক বেশি ছিল। রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা সেই মহিমার ভাগ লইতে আসিয়াছিলেন। বৃহত্তর সমাজও। দেশ জুড়িয়া এখন ‘সনাতন ভারত’ প্রতিষ্ঠার খেলা। আরাধনার উপবাস সেই ছকে দিব্য মিলিয়া গিয়াছিল। ব্যক্তি-আরাধনা গৌণ, মুখ্য ছিল সনাতন ভারতের প্রথার প্রতি তাহার অবিচল শ্রদ্ধা। মৃত্যু আসিয়া তাহার জীবনের দাম বাড়াইয়াছে। যে পুলিশ দশ সপ্তাহ নির্বিকার ভঙ্গিতে খেলা দেখিতেছিল, তাহারা এফআইআর করিয়াছে। যে সমাজ আরাধনাকে ‘বাল তপস্বী’ বানাইয়াছিল, সে ধর্নায় বসিতেছে।

আরাধনা স্বেচ্ছায় উপবাসে বসিয়াছিল কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলিবে না। মেয়েটি জীবিত থাকিলেও মিলিত, সেই নিশ্চয়তা নাই। কারণ, প্রত্যক্ষ কোনও চাপ না থাকিলেও কী ভাবে পরোক্ষ চাপ অসহ হইতে পারে, ‘স্বেচ্ছায়’ সতী হওয়া বহু নারীই তাহার সাক্ষ্য দিতে পারিতেন। উপবাস বা সান্থারার ধর্মীয় প্রথাটি আদৌ থাকা উচিত কি না, সেই তর্ক যদি অমীমাংসিত থাকেও, ধর্মীয় প্রথাকে যে সামাজিক পরিসরের ‘দ্রষ্টব্য’ করিয়া তোলা চলে না, তাহা সংশয়াতীত। নেতা-মন্ত্রীরা যে অনুষ্ঠানে ছবি তুলাইয়া আসেন, প্রশাসনের সাধ্য কী তাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লয়। সমাজ যেখানে ‘বাল তপস্বী’-র প্রশংসায় মাতে, সেখানে মেয়েটির সম্মতি লইয়া প্রশ্ন তুলিবার সাহস আর কাহার থাকে! আরাধনার মৃত্যুর পর আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা যদি দায়ের করা হয়ই, অভিযুক্তের তালিকাটি দীর্ঘতর হওয়াই বিধেয়।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy