শিবমহিমার উত্স বাঙালির বুদ্ধভক্তি
আনন্দবাজার পত্রিকার (১৮-২) উত্তর সম্পাদকীয় দুটি যথেষ্ট মনোগ্রাহী ছিল। প্রথম নিবন্ধটি ‘মুসলমান শাসকরা জোর করে ধর্মান্তর করালে এ দেশে একজনও হিন্দু থাকত না’ এবং দ্বিতীয়টি জহর সরকারের লেখা ‘শিবের মতো বর চাইতে শেখানো হল কেন?’ দুটি নিবন্ধেই আমাদের দেশের অতীত ইতিহাস নিয়ে চর্চা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বাংলার সুলতানি আমলের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। খুলনা জেলার কাছে একটি মহকুমার নাম ছিল বাগেরহাট। বাগেরহাটের রাজধানী শহরটির তত্কালীন নাম ছিল খলিফতাবাদ। এই খলিফতাবাদ-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল ছিল এক তুর্কি যোদ্ধা খান জাহান আলির শাসনাধীন। সে কালের রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর পর সমাধির জন্য খলিফতাবাদে একটি সমাধি মন্দির নির্মাণ করতে তার পাশে একটি বিশাল আয়তনের দিঘি খনন করা হয় একটি পুরাতন দিঘির সংস্কার করে। দিঘিটি খনন করার সময় একটি পাথরের বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেল মাটির তলা থেকে। এই তুর্কি সেনাপতি তাঁর অনুুগত একজন ব্রাহ্মণ সন্তান মহেশ ব্রহ্মচারীকে মূর্তিটি পূজা করার জন্য দান করলেন। শোনা যায়, খান জাহান আলি বেশ কয়েক একর নিষ্কর জমিও দান করেছিলেন এই মহেশ ব্রহ্মচারীকে ঠিকঠাক ভাবে পূজা অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য। মূর্তিটি শহরের পাশে বয়ে যাওয়া নদীটির অপর প্রান্তে একটি গ্রামে ‘শিব’ বলে পূজিত হতে লাগল। এ সব ঘটনা পনেরো শতকের। আমরা বাল্যকালে দেখেছি, দূূরদূরান্ত থেকে ভক্ত নরনারী পায়ে হেঁটে, নৌকায় নদী পার হয়ে এই গ্রামে (পরবর্তী কালে যে গ্রামটি শিববাড়ি বলে পরিচিত হয়েছিল) সেই শিবকে পূজা দিতে যেতেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন খানসেনারা মন্দিরটির উপর ধ্বংসলীলা চালায়। পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সরকার মূর্তিটি ঢাকায় অবস্থিত মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত করে। এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশে যে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল এক সময় বহুল ভাবে আর তা সময়ের তালে তালে শিবপূজায় পরিবর্তিত হয়ে গেল এটা বোঝা যায়। আগে যা ছিল বুদ্ধমূর্তি তা পরিবর্তিত হল শিবরূপে। বাঙালি ভক্তদের মনে যা ছিল বুদ্ধদেবের রূপে তাই পরিবর্তিত হল দেবাদিদেব মহাদেব রূপে। বাংলার সমাজে শিবের যে বিপুল মহিমা তা জহরবাবু প্রত্যক্ষ করেছেন। সে কি এখনকার জনগোষ্ঠীর অন্তরস্থলে রক্ষিত বুদ্ধভক্তির পরিবর্তিত রূপ নয়? আর খান জাহান আলির এই মূর্তিটি ভেঙে না-ফেলে হিন্দু ভক্তের হাতে পূজার্থে দান করাটা কি প্রথম নিবন্ধটির সত্যতা প্রমাণ করে না?
দেবপ্রিয় নাগ। কলকাতা-৯১
শিবের মতো বর
জহর সরকার ‘শিবের মতো বর চাইতে শেখানো হল কেন?’ (১৮-২) শীর্ষক নিবন্ধে শিব ও শিবরাত্রির ব্রত সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মোটামুটি একমত হয়েও আরও দুটি কথা যোগ করতে চাই।
একেকটি ভাবকে ভাব রূপে চিন্তা করার থেকে মূর্ত রূপে চিন্তা করতে সুবিধা হয় বলেই আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টি করেছি। এবং কোনও কোনও দেবদেবীতে একাধিক ভাবের সমন্বয় ঘটেছে এবং এঁদের উত্সও একাধিক। শিব নামক অন্যতম প্রধান দেবতার উত্স চারটি। প্রথমত, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো সভ্যতার চিহ্নগুলিতে যে পশুপরিবৃত দেবতাকে দেখা যায় তাঁকেই ‘পশুপতি’ শিবের আদি রূপ বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ বা উর্বরতা তথা জীবনের উত্স শক্তির পূজা প্রচলিত ছিল। লিঙ্গপূজা তার একটি অঙ্গ। এবং এই প্রথা শিবপূজা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়। যার ফলে শিবকে লিঙ্গরূপেও কল্পনা করা হয়। যাঁরা শিবকে উপনিষদের ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’ ভাবের প্রতীক হিসেবে দেখেন তাঁরা বলেন শিবলিঙ্গের প্রকৃত রূপ লিঙ্গাকার নয়। অধর্র্গোলাকৃতি, অর্থাত্ বৃত্তাকার জগত্ বা বৃত্তাকার ব্রহ্মাণ্ডের দৃশ্যমান অংশটুকু। এবং এই ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’ ভাবই বর্তমান মহাদেব শিবের প্রধান ভাব। তাই তাঁকে ধ্যানমগ্ন যোগীশ্বর হিসেবে কল্পনা করা হয়। এবং চতুর্থ ভাব বা চতুর্থ উত্স হলেন প্রলয়ঙ্কর নটরাজ। যিনি মহাকাল এবং ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টি সম্ভব করেন। এই মহাকাল এবং মহাকালী প্রকৃতপক্ষে একই শক্তিকে পুরুষ বা নারীরূপে কল্পনা। এই ভাবগুলি কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়। কারণ, ধ্বংস ও সৃষ্টি পরস্পরের পরিপূরক। এবং শিবভক্তরা নিজেদের পছন্দ মতো এক বা একাধিক ভাব বেছে নেন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, মেয়েরা শিবের মতো বর চায় কেন। অল্পবয়সি মেয়েদের মাথায় স্বামী চেয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করার ইচ্ছা ঢুকিয়ে দেওয়ার আমিও তীব্র বিরোধী। এটা অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক মগজধোলাই। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, দেবতাদের মধ্যে শিবই একমাত্র দেবতা যিনি নিজের স্ত্রীকে নিজের সমকক্ষ এবং প্রকৃত অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে দেখেন এবং পূর্ণ সম্মানের আসন দেন। তিনি নারায়ণের মতো স্ত্রীকে দিয়ে পদসেবা করান না। তিনি রামের মতো কথায় কথায় স্ত্রীত্যাগ করেন না বা স্ত্রীকে অগ্নিদগ্ধ হতে দেখতে চান না। তিনি ইন্দ্রের মতো ছদ্মবেশ নিয়ে অহল্যার মতো নারীদের ছলনা করে ধর্ষণ করেন না। তিনি সতীর মৃত্যু হলে সব কিছু ত্যাগ করে সতীর দেহ নিয়ে বিশ্বপরিক্রমা করে বেড়ান। এবং সেই দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়ার পর যুগযুগান্ত ধরে শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন। পত্নী যখন কালীরূপে প্রলয়ঙ্করী তখন তাঁকে শান্ত করার জন্য তাঁর সামনে বুক পেতে শুতে শিব অপমান বোধ করেন না। ঈশ্বর পুরুষ এবং জড় প্রকৃতি নারী এই জনপ্রিয় ভয়ঙ্কর ধারণার মূর্ত প্রতিবাদ শিব-দুর্গার অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। তাই কোনও দেবতার মতো স্বামী নিতান্ত যদি চাইতেই হয়, তবে শিবকেই একমাত্র যোগ্য দেবতা বলে মনে হয়। তথাকথিত অবতার মাতৃঘাতী পরশুরাম, ‘মর্যাদাপুরুষোত্তম’ পত্নীত্যাগী রাম যিনি বাল্মীকির রামায়ণে (তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানসে’ নয়) স্ত্রীর অগ্নিপ্রবেশের আগে তাঁকে সর্বসমক্ষে বহু কটু কথা বলেছিলেন শুধুমাত্র হয়তো ধর্ষিতা হয়ে থাকতে পারেন এই সন্দেহে। এঁদের মতো স্বামী বা পুত্র যদি কোনও নারী চান তাঁকে তো মানসিক চিকিত্সালয়ে পাঠানো প্রয়োজন। রামের ওই বার্তার জন্যই বোধহয় কিছু দিন আগে পর্যন্তও ধর্ষিতা স্ত্রীকে ত্যাগের প্রথা প্রচলিত ছিল।
সুস্মিতা ভট্টাচার্য। কলকাতা-২৬
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy