Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু

সন্ত্রাসবাদী বলা ঠিক নয়, তার দরকারও নেই

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১

সন্ত্রাসবাদী বলা ঠিক নয়, তার দরকারও নেই

সম্পাদকীয় ‘অবশ্যই সন্ত্রাসবাদী’ (১৩-৮) এবং অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কেউ বলে সন্ত্রাসবাদী কেউ বলে বিপ্লবী’ (১৫-৮) প্রবন্ধ পড়লাম। প্রথমেই জানিয়ে দিতে চাই যে, যাঁদের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বইতে ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে তাঁদের ‘সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী’ বলাই সঙ্গত বলে আমি মনে করি। বিপ্লব শব্দটির মধ্যে সমাজবদলের যে সুনির্দিষ্ট রূপরেখার ধারণা আছে তা সশস্ত্র পথের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেতনায় অনেক পরে এসেছিল। বলশেভিক বিপ্লবের পর ধীরে ধীরে অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি গুপ্তসমিতিগুলির মধ্যে মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটে। পঞ্জাবে ভগৎ সিংহের উপর লেনিনের প্রভাব বিশেষ ভাবে পড়েছিল। তিরিশের দশকে এর প্রবণতা আরও বাড়ে। বহু সশস্ত্র সংগ্রামী আন্দামানে সেলুলার জেলে বসে মার্ক্সীয় দর্শন অধ্যয়ন করে কমিউনিস্ট হন। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ ভাবে সমাজবদলের কোনও কর্মসূচি এঁরা নেননি। তাই এঁদের বিপ্লবী না বলাই সঙ্গত। ত্রিশের দশকেও চট্টগ্রাম বিদ্রোহে সূর্য সেনদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিতাড়ন।

এঁদের বিপ্লবী বলা না-গেলেও সন্ত্রাসবাদী বলাটাও সঙ্গত নয়। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের অফিসাররা ‘অ্যানার্কিস্ট’, ‘টেররিস্ট’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। ডিরেক্টর অব ইন্টেলিজেন্স সি আর মিডল্যান্ড তো এঁদের ‘পলিটিকো-ক্রিমিনাল কনস্পিরেটর’ বলে নিন্দা করেন। সশস্ত্র সংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী তকমা ব্রিটিশরাই দিয়েছে। (দ্র: অনুশীলন সমিতির ইতিহাস, সম্পা: অমলেন্দু দে, পৃ ১৬-১৭)। আমাদেরই এখন স্থির করতে হবে আল কায়দা, এলটিটিই-র সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একই আসনে বসাব কি না। হয়তো এই সব সংগঠন ইসলামের প্রসার বা তামিল ইলমের জন্য লড়ছেন। তাঁদের লক্ষ্যের প্রতি কোনও অসম্মান না-জানিয়েই দ্বিধাহীন কণ্ঠে এটুকু বলা যায় যে, আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামীরা অন্তত নিরীহ মানুষদের হত্যা করে আতঙ্ক তৈরি করতে চাননি। ক্ষুদিরাম বসু ভ্রমক্রমে নিরীহ মানুষদের উপর বোমা ছোড়েন বটে, তবে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। সশস্ত্র সংগ্রামীরা চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও কখনও নিরীহ মানুষকে আক্রমণ করেননি। পুলিশের প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ অনেক সময় তাঁদের ডাকাত ভেবে তাড়া করেছে। সশস্ত্র সংগ্রামীরা তাদের পাল্টা আক্রমণ করেননি।

সুদূর অতীত থেকেই মানুষের মুক্তিসংগ্রামের দুটি গ্রাহ্য ধারা আছে। সশস্ত্র এবং অহিংস। সশস্ত্র আন্দোলন তখনই সন্ত্রাসবাদ হয়ে ওঠে যখন তা নিরীহ মানুষকে আঘাত করে। ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অন্তত এটুকু সংযম দেখিয়েছিলেন। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নিজেদের জন্য বিপ্লবী, মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত, স্বাধীনতা সংগ্রামী— এই সব বিশেষণই ব্যবহার করতেন। কোথাও নিজেদের সন্ত্রাসবাদী বলে থাকলেও তা নিতান্তই ব্যতিক্রমী, ঔপনিবেশিক তকমাটির আত্মীকরণ মাত্র। সন্ত্রাসবাদী তকমায় দেগে দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তনটিও ধরা যাবে না।

এটাও বলা দরকার যে, যাঁরা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী বলতে চান না, তাঁরা যে সবাই পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে চাইছেন, এমনটা না-ও হতে পারে। নির্মোহ ইতিহাস রচনার অর্থ বর্তমানে তৈরি হওয়া কোনও তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে অতীতকে যেন তেন প্রকারেণ ঢুুকিয়ে দেওয়া নয়। বাঘা যতীন, দীনেশ গুপ্তর চিঠিগুলি বা বীণা দাশের স্টেটমেন্ট দেশ ও দেশের মানুুষের প্রতি তাঁদের ভালবাসা, আত্মত্যাগ, পরাধীনতার লজ্জা ঘোচানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতির জ্বলন্ত দলিল। বিপ্লবীদের অপছন্দের আর সাহেবদের পছন্দের সন্ত্রাসবাদী তকমাটি তাঁদের গায়ে লাগিয়ে দিলে যুগের হৃৎস্পন্দন অনুভব করা যাবে না।

সুখের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিম্নশ্রেণির পাঠ্যপুস্তক রচনায় উদ্যোগী হয়েছেন। জেনে রাখা ভাল নিম্নশ্রেণিগুলিতে যাঁরা ইতিহাস পড়ান তাঁদের অনেকেরই ইতিহাসে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। শিক্ষকের সংখ্যার স্বল্পতার কারণে ডিগ্রিধারীদের জন্য বরাদ্দ করতে হয় উচ্চশ্রেণির ক্লাসগুলিকে। সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত যে জাতীয় অ্যাকাডেমিক বিতর্ক সিলেবাস রচয়িতারা দাবি করছেন সেটা এই পরিকাঠামোয় সম্ভব তো? সরকারি বইয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী অভিধা দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত?

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ

¶ ২ ¶

সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, “অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসে ক্ষুদিরাম বসুদের ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ বললে ক্ষতি কোথায়? ছেলেমেয়েরা কি বুঝিবে না, ক্ষুদিরাম আর কসাবের মধ্যে তফাত কোথায় এবং কেন?” আর অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে, ক্ষুদিরামদের সন্ত্রাসবাদী বলায় যাঁদের আপত্তি, তাঁদের যুক্তি হিসেবে লেখক নিজেই বলছেন, “২০০১ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর থেকে সাধারণ অর্থে ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটির মূল কথা হল, নির্বিচার নৃশংস গণহত্যার ঠিকাদার।... এদের একমাত্র লক্ষ্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মারা এবং বিরোধী পক্ষকে ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে নতজানু করা। অর্থাৎ যে শব্দ এই মৃত্যু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাকে দিয়ে ক্ষুদিরামের বর্ণনা করার অর্থ তাদের স্বার্থত্যাগের অপমান বা অপলাপ। তরলমতি কিশোর কিশোরীদের ভুল ইতিহাস শেখানো।” এর পরেই তাঁর মন্তব্য,“সন্ত্রাসবাদী এবং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী দুটো শব্দের অর্থকে যাঁরা আলাদা করে দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা দুটোই ফিরে পড়তে হবে। প্রয়োজন একটা সুস্থ এবং যুক্তিতথ্যনিষ্ঠ বিতর্ক।” অর্থাৎ একটি সুস্থ এবং যুক্তিতথ্যনিষ্ঠ বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা তিনি স্বীকার করছেন।

চার দশক ধরে ইতিহাসের গবেষক, অধ্যাপক তথা ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু এঁদের বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী বলে আসেননি। কেউ বলেছেন বিপ্লবী, কেউ বলেছেন সন্ত্রাসবাদী। যদি বিপ্লবী এবং সন্ত্রাসবাদী দুটো কথারই অর্থ এক হয়, তা হলেও একই অর্থের দুটো শব্দকে জুড়ে দিয়ে একটি শব্দবন্ধ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি? আর, লেখক ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা দুটোই ফিরে পড়ার জন্য যে তির্যক মন্তব্য করেছেন সে প্রসঙ্গে বলি, কিছু শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং বিশিষ্ট অর্থ থাকে। যেমন, মহাজন কথার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ মহৎ জন বা মহৎ ব্যক্তি। আর সময়ের পরিবর্তনে তার বিশিষ্ট অর্থ দাঁড়ায় সুদখোর। সে জন্য মহাজনি কারবার-এর অর্থ যদি কেউ ‘মহৎ জনের কারবার’ দেখাতে চান তা হলে তা ব্যুৎপত্তিতে টিকলেও প্রয়োগে টিকবে না।

তেমনই সন্ত্রাসবাদী শব্দটি ক্ষুদিরাম ইত্যাদির জন্য আগে কেউ কেউ ব্যবহার করলেও সময়ের ব্যবধানে এখন তা একটি বিশিষ্ট অর্থের দ্যোতক হয়ে উঠেছে। যেমন নিবন্ধ লেখকেরই লেখায়, “এক শিশু সাহিত্যিক তথা ছায়াচিত্রনির্মাতা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, সন্ত্রাসবাদী শব্দটা শুনলেই তাঁর চোখের সামনে ওই ছত্রপতি শিবাজী রেলস্টেশনে গণহত্যারত কসাবের ছবিটা ভেসে ওঠে আর শরীর মন রাগে ঘৃণায় কাঁপতে থাকে।” সুতরাং লেখক যে তাঁর নিবন্ধের শেষে প্রশ্ন তুলেছেন, “যদি পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের ইতিহাস শিক্ষকরা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ধারণাটির ঠিক অর্থ ক্লাসে বোঝাতে না-পারেন তা হলে খামতিটা ছাত্রদের না তাঁদের?” এই প্রশ্নটা তো শুধু তরলমতি ছাত্রদের মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না, তাঁর নিজেরই নিবন্ধে উল্লিখিত শিশুসাহিত্যিক তথা ছায়াচিত্রনির্মাতার পক্ষেও প্রযোজ্য। তাঁদেরও ঠিক অর্থ বোঝানোর জন্য কত শিক্ষক দরকার হবে? বা তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?

লেখক আরও জানিয়েছেন, কিছু ইতিহাসবিদকে সরকার এই বিতর্কের সমাধান করতে আহ্বান করেছেন। তাঁরা এই বিতর্কের কী সমাধান দেবেন জানি না। তবু সকলের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি, সব সেন্সের উপর যে সেন্স তাকে বলে কমন সেন্স। আর এই কমন সেন্স থেকেই আমি একটা প্রস্তাব রাখছি, ক্ষুদিরাম ইত্যাদিকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী না বলে বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী বা চরমপন্থী বিপ্লবী বলা হোক। স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটি ধারা ছিল: অহিংস এবং সহিংস। বা, নরমপন্থী বিপ্লব ও চরমপন্থী বিপ্লব।

পরেশচন্দ্র দাস। কলকাতা-১০৬

letters to the editor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy