শরীরে কেমন ভাবে তৈরি হচ্ছে প্রোটিন, কী ভাবে চলাচল করছে রক্ত, জানতে পারলেই গবেষকেরা বলে দিতে পারেন, আগামী দিনে হৃদ্রোগের কতটা আশঙ্কা রয়েছে। অথবা, কতখানি প্রাণঘাতী হতে পারে সেই আঘাত। জীববিদ্যার সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তির মিশেলে মানুষের হাতে উঠে এসেছে এমনই ভবিষ্যৎ গণনার ক্ষমতা।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে গবেষণার ধারা। সাধারণ পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা বা রসায়নের বদলে নতুন বিষয় নিয়ে তৈরি হচ্ছে মানুষের আগ্রহ, যা আরও আধুনিক করে তুলতে পারে জীবন। কৃত্রিম মেধা, ডেটা অ্যানালিসিস, মেশিন লার্নিং-এর মতো বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে। ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট’ অর্থাৎ বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা এবং কেরিয়ার গড়ার দিকেই এগোতে চাইছেন পড়ুয়ারা। তেমনই একটি বিষয় বায়োইনফরমেটিক্স।
কী এই বায়োইনফরমেটিক্স?
জীববিদ্যার সঙ্গে ইনফরমেশন টেকনোলজির মিশেলেই তৈরি ‘বায়োইনফরমেটিক্স’। জীববিদ্যার সঙ্গেই গণিত, রাশিবিজ্ঞান এবং কম্পিউটার সায়েন্স-এর উপাদান রয়েছে। তাই একে ‘ডায়নামিক’ আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
গুজরাত বায়োটেকনোলজি ইউনিভার্সিটি-র ডিরেক্টর অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “মানবশরীর আগে থেকেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হৃদ্যন্ত্রে গোলযোগের আগেই কিছু বিশেষ প্রোটিন রক্তে প্রবাহিত হতে শুরু করে। প্রোটিনের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করলে জানা যেতে পারে, হৃদ্রোগ কতখানি প্রাণঘাতী হতে পারে।”
ছবি: সংগৃহীত।
কারা পড়তে পারবেন?
দ্বাদশে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা থাকলে বায়োইনফরমেটিক্স নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়া যায়। এ ছাড়াও স্নাতকোত্তর স্তরেও ওই বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞান, কিংবা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরও এই বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকে।
কোথায় পড়ার সুযোগ?
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের কোর্সে বায়োইনফরমেটিক্স পড়ানো হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও বর্তমানে ওই বিষয়গুলি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত:
প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে, প্রযুক্তির জ্ঞান কিংবা জীববিদ্যার প্রতি আগ্রহ থাকলেই বায়োইনফরমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি আদতে তেমন নয়, বলেই দাবি বোস ইনস্টিটিউট-এর অধ্যাপক গৌরব গঙ্গোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, “বায়োইনফরমেটিক্স-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অবদান থাকলেও ‘পিয়োর সায়েন্স’-এর গভীর জ্ঞান অবশ্যই প্রয়োজন। মূল তত্ত্বগত জ্ঞান না থাকলে পড়াশোনা খানিকটা যন্ত্রনির্ভর হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর স্তর থেকে বায়োইনফরমেটিক্স নিয়ে চর্চা করতে পারলে পড়ুয়ারা শিখতে পারবে।”
তবে, বায়োইনফরমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে নানা যন্ত্র, ডেটাবেস নিয়ে কাজ করতে হয়। ওই যন্ত্র বা তথ্যসূচির মাধ্যমে প্রোটিন স্ট্রাকচার, জেনেটিক সিকোয়েন্স, জিন এক্সপ্রেশন, ডিজ়িজ় মেকানিজ়ম-এর মতো বিষয়গুলি শেখার সুযোগ রয়েছে। তাই, যাঁরা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, কিংবা জীববিদ্যার মতো বিষয় নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের আলাদা করে প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন করা দরকার।
ছবি: এআই।
চাকরির সুযোগ:
বিজ্ঞানী শুভলক্ষ্মী ঘোষের মতে, “যে পড়ুয়ারা এই বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে এগোতে চাইছে, তারা গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে অন্ত্রেপ্রেনিয়রশিপ-এর পথেও এগোনোর কথা ভাবতে পারেন। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়ুয়ারা কাজের সুযোগ পাবে।”
ওষুধ বা প্রতিষেদক তৈরি, রোগ নির্ণয়, পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ থেকে শুরু করে তথ্য বিশ্লেষণ এবং ডেটাবেস তৈরির কাজে এমন বিশেষজ্ঞদের চাহিদা রয়েছে। তাই চাকরির ক্ষেত্রে ফার্মাসি, চিকিৎসা পরিষেবা-সহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার বায়োডোমেন রিসার্চ ফেসিলিটিতে কাজের সুযোগ থাকে।
এ ছাড়াও জিনোম সিকোয়েন্সিং ল্যাবে গবেষক হিসাবে অথবা ডেটা সায়েন্টিস্ট পদেও চাকরি পাওয়া যেতে পারে।
পড়ুয়ারা কী বলছে?
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত 'বায়োস্পেকট্রাম'-এ যোগদান করেছিল কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলার স্কুল পড়ুয়ারা। সেই অনুষ্ঠানে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোবিন্দপুর রত্নেশ্বর হাই স্কুলের একাদশের ছাত্র শিবাজিৎ ঘোষ বায়োইনফরমেটিক্স নিয়েই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। জীববিদ্যা নিয়ে চর্চার সঙ্গে কম্পিউটারের প্রযুক্তির সংযোজন হওয়ায় তার আগ্রহ বেড়েছে। ওই স্কুলেরই আরও এক ছাত্র কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল বায়োপ্লাস্টিক নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য বায়োটেকনোলজি কিংবা সমতুল বিষয় সে বেছে নেবে। বায়োইনফরমেটিক্স-এ পরিবেশ রক্ষা, কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সুস্থায়ী জীবনযাত্রার বিষয়গুলিও রয়েছে। তাই কলকাতার শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের একাদশের কৌস্তভ মাঝি, ভবন’স গঙ্গাবক্স কানোরিয়া বিদ্যামন্দিরের একাদশের পড়ুয়া সুস্নাত বন্দোপাধ্যায় এবং ঋতি ভট্টাচার্যরাও এই বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়।