এক দেশ, এক শিক্ষা!
অন্তত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কি এমনই চাইছে কেন্দ্র? ২০১৮ সাল থেকেই উঠতে শুরু করেছিল প্রশ্নটি। সে বছরই ঘোষণা হয়েছিল দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হবে। তৈরি হবে এমন এক কেন্দ্রীয় সংস্থা যা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষকশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য কাজ করবে।
শিক্ষামহলের একাংশ মনে করছে, শিক্ষাব্যবস্থায় এক দেশ এক নীতি চালু করার লক্ষ্যেই এগোতে চাইছে কেন্দ্র। অন্তত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো বটেই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ তার প্রথম ধাপ যদি হয়, দ্বিতীয় ধাপে হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া বিল, ২০২৫ থাকবে। এই আইনের হাত ধরেই সারা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ছাতার তলায় রাখতে চাইছে কেন্দ্র। ১ ডিসেম্বরের শীতকালীন অধিবেশনে এই বিল পেশ করা হবে। খসড়া বিল তৈরি হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে কার্যকর ইউজিসি, এআইসিটিই এবং এনসিটিই-র মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির পরিবর্তে একটি সংস্থা কাজ করবে সারা দেশে— এমনই বলা হচ্ছে এই বিলে। এই সংস্থাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের পঠনপাঠন, মানোন্নয়নের মতো বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করেছে। আর এখানেই প্রশ্ন তুলছে রাজ্যগুলি। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা যুগ্মতালিকার অন্তর্গত। সেখানে এই কেন্দ্রীভূত কমিশন কতখানি সহায়ক হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি-র সাধারণ সম্পাদক তরুণকান্তি নস্করের কথায়, “স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের নিয়ম মেনে চলতে হয়। নবনিযুক্ত কাউন্সিল প্রতিটি রাজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদৌ সিদ্ধান্ত নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।”
ইউজিসি-র সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পুনর্নির্মাণের পথে কি হাঁটবে নতুন কমিশন? ছবি: সংগৃহীত।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় জানিয়েছেন, দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসার, গুণমান রক্ষার জন্যই শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবে ১৯৫৩ সালে ইউজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৬ সাল থেকে তা কার্যকরী হয়েছে। এই সংস্থার হাতেই দেশের উচ্চশিক্ষার আর্থিক দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল। তাঁর দাবি, গত কয়েক বছরে একটু একটু করে ইউজিসি আর্থিক দায়িত্ব কার্যত ঝেড়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, “উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বরাদ্দ সমস্ত প্রকল্প ও আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এক এক করে। ইউজিসি-র সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করে পুনর্নির্মাণের পথে না হেঁটে কেন্দ্র তাকে বিলুপ্ত করে দিতে চাইছে। আমরা মনে করি, এই সিদ্ধান্ত এক অসম প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির আখেরে ক্ষতি করবে।”
কেন এমন মনে করছেন?
শিক্ষকদের একাংশের দাবি, ভারতের সামাজিক ন্যায়, সাম্য ও সকলের জন্য শিক্ষা মডেলটিকে কার্যত বাতিল করে দিতে পারে এই বিল। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে আপাত গুণমাণ ও উৎকর্ষকে সামনে রেখে শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ সম্পন্ন হতে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির জীবনীশক্তিই হয়তো বিনষ্ট হবে। নতুন আইন পাশ হলে আমলাতান্ত্রিকতা ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যে দিকে বাঁক নেবে তা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলেও দাবি করেছেন পার্থপ্রতিম রায়ের মতো অধ্যাপকেরা।
শিক্ষকমহলের আশঙ্কা, নতুন আইনে স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাত থেকে পরিচালনার দায়িত্ব কেড়ে নিতেও পারে কেন্দ্র। তার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বাধীন গবেষণার অধিকার।
কী ভাবে কাজ করবে নতুন কমিশন?
জানা গিয়েছে, নতুন কমিশনে মোট চারটি কাউন্সিল থাকবে। ‘ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেটরি কাউন্সিল’ শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ কী ভাবে সম্পূর্ণ হচ্ছে, তাতে নজরদারি করবে। এই কাজটি আগে এআইসিটিই এবং ইউজিসি করত।
পড়ুয়ারা কতটা শিখতে পারল, কর্মসংস্থানে হার কেমন, কী ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কতটা কাজ করতে পারছে— এই সবটা দেখবে ‘ন্যাশনাল অ্যাক্রিডেশন কাউন্সিল’। মনে করা হচ্ছে, ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রিডেটশন কাউন্সিল (নাক), ন্যাশনাল বোর্ড অফ অ্যাক্রিডেশন (এনবিএ)— এই দু’টি কাউন্সিল-এর বদলে ওই বিভাগ গঠন করা হবে।
দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুদান সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ‘হায়ার এডুকেশন গ্রান্টস কাউন্সিল’।
‘জেনারেল এডুকেশন কাউন্সিল’ দেখবে পাঠক্রম, মূল্যায়নের বিষয়গুলি। কেন্দ্রের দাবি, এতে পড়ুয়ারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে পারবেন সহজে। এ জন্য রাজ্য স্তরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কারা থাকবেন শীর্ষ পদে?
নতুন কাউন্সিলে এক জন চেয়ারপার্সন, এক জন ভাইস চেয়ারপার্সন এবং কেন্দ্রের বাছাই করা ১২জন সদস্য থাকবেন। ওই ১২ জনের মধ্যে কেন্দ্রের উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন, অন্ত্রেপ্রেনিওরশিপ বিভাগের তরফে প্রতিনিধিত্ব করবেন। রাজ্য স্তরের কোনও ফিজিক্যাল থাকবে কি না তা কিন্তু স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষকদের স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পৌরোহিত্য করবে কোন কমিটি? —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কোথায় আশঙ্কা?
১৯৫৬ সালের ইউজিসি আইন অনুযায়ী, কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ম ভাঙলে তাকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হত। কিন্তু নতুন আইন কার্যকর হলে, বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের পাশপাশি অনুমোদন বাতিলের সম্ভাবনাও থাকছে। ফলে কেন্দ্রের নীতি মানতে বাধ্য হবে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরল, ত্রিপুরা, মিজ়োরাম, মণিপুরের মতো রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা আদৌ কাউন্সিলে থাকবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ এই রাজ্যগুলিতে ইংরেজির পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় পঠনপাঠন হয়, হিন্দিতে নয়। সে ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম নির্ধারণে স্থানীয় ভাষাকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে আশঙ্কার মেঘ ঘনাচ্ছে।
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা
অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন (এআইএসএইচই), ২০২১-২০২২ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ১,১৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৫,৪৭৩ টি কলেজ, ১২,০০২টি স্ট্যান্ড অ্যালোন ইনস্টিটিউশনে রয়েছেন প্রায় ৪.৩৩ কোটি পড়ুয়া। এঁদের জন্য নিযুক্ত ১৫.৯৮ লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা।
১৯৯৫-এ প্রতিষ্ঠিত এনসিটিই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি নির্ধারণ করেছে। সেই কাজও নতুন কাউন্সিল সামলাবে। কাউন্সিল নির্ধারিত পাঠ্যক্রম, পঠনপাঠনের পদ্ধতিতে বদল এলে শিক্ষক নিয়োগের উপরও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এত দিন পর্যন্ত রাজ্যস্তরের সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব ছিল রাজ্যেগুলির হাতে। জটিলতা সেখানেও ছিল। তবে কেন্দ্রীভূত নীতি কার্যকর হলে শিক্ষক নিয়োগ কী ভাবে হবে, যোগ্যতা যাচাই কারা করবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
নতুন বিলে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য সার্চ-কাম-সিলেকশন কমিটি গঠন করা হবে বলে দাবি। কিন্তু সেই কমিটিতে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি থাকবেন, না কি রাজ্যের, পৌরোহিত্য করবেন কে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই বা কার— তা স্পষ্ট নয়।