জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে উচ্চশিক্ষার ধরন-ধারণ। স্নাতক স্তরের পঠনপাঠন তিন থেকে চার বছরে উন্নীত করা হয়েছে। এর মধ্যে পঠনপাঠনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে হাতেকলমে কাজ শেখার সুযোগ। ইন্টার্নশিপ-এর জন্য বিশেষ নম্বর পেয়ে থাকেন পড়ুয়ারা।
সে ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধিই হয়ে উঠছে মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ, সরাসরি বৃত্তিমুখী হয়ে উঠছে উচ্চশিক্ষা। স্নাতক স্তরে পড়তে পড়তেই ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’-এ যোগ দিতে পারছেন পড়ুয়ারা। বইয়ের পড়াশোনাকে আরও বেশি বাস্তব প্রয়োগের দিকে এগিয়ে দিতেই এই ব্যবস্থা বলে দাবি করা হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে। কিন্তু সেখানেই প্রশ্ন তুলছে শিক্ষকের একাংশ। অভিযোগ, এই দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বৃত্তিমুখিনতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানচর্চার পরিসর। আখেরে বঞ্চিত হচ্ছেন পড়ুয়ারাই।
সে কথাই জানালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড অপটিক্স অ্যান্ড ফোটোনিক্স-এর বিভাগীয় প্রধান কল্লোল ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “সিভি বা জীবনপঞ্জি উন্নত করতে ছুটছেন পড়ুয়ারা। এ জন্য কাজের পরিবেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু তার ফলে ক্লাসে বাড়ছে অনুপস্থিতির হার। নিয়মিত পঠনপাঠনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পড়ুয়ারা ইন্টার্নশিপ করতে যাচ্ছেন। এতে তাঁদের দোষ নেই, এমনই তো করতে বলা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে জ্ঞান। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে দেশের, সমাজের।”
বাস্তব বলছে, এ দেশে গত কয়েক দশকে অধিকাংশ পড়ুয়াই স্নাতক স্তরের পঠনপাঠন শেষ করে খোঁজ করেন চাকরির। সে ক্ষেত্রে পঠনপাঠন শেষের আগেই ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা থাকলে তা কাজ পেতে সুবিধা তৈরি করতে পারে। কিন্তু বাস্তব ছবিতে অসুবিধা অন্যত্র।
এমনিতেই সেমেস্টার পদ্ধতিতে প্রতি ছ’মাস অন্তর পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তারও মধ্যে যদি কোনও পড়ুয়া তিন-চার মাস ইন্টার্নশিপ বা স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এ যোগ দেন, তা হলে মূল পড়াশোনাটা করবেন কখন?
কেন্দ্র দাবি করেছিল, আন্তর্জাতিক স্তরের পঠনপাঠনের সঙ্গে সাযুজ্য আনতে কলেজ স্তর থেকেই কর্মমুখী হওয়ার বিষয়ে জোর দিতে চাইছে তারা। তাই নতুন শিক্ষানীতিতে পঠনপাঠনের পাশাপাশি গবেষণার সুযোগও পেয়ে থাকেন পড়ুয়ারা। কিন্তু এত তাড়াহুড়োয় আদতে পড়ুয়াদের মানসিক গঠন ঠিক মতো হচ্ছে না বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষক। তাতে থমকে যাচ্ছে আদর্শ এবং বোধের বিকাশ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ নস্কর বলেন, “চাকরি বা ইন্টার্নশিপের রঙিন মোড়কে পড়ুয়ারা হাতে পাচ্ছে শুধু একটা ডিগ্রি। বাস্তবে সেই শিক্ষা কতখানি কাজে লাগানো সম্ভব, কী ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব সেই বোধ তৈরি হচ্ছে কি না, সন্দেহ রয়েছে।” পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, সুনাগরিক হিসাবে যে বোধশক্তির প্রয়োজন তা গড়ে ওঠে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, শিক্ষক-সহপাঠীদের সাহচর্যে। সেখানেও ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। তাঁর দাবি, সুকৌশলে সকলের জন্য শিক্ষার ভাবনা মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বছরে দু’টি করে সেমেস্টার, তারই সমান্তরালে ইন্টার্নশিপ, ট্রেনিশিপ, কিংবা স্কিল এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রামের জেরে ব্যাহত হচ্ছে সারা বছরের পঠনপাঠন, জানাচ্ছেন বেশির ভাগ শিক্ষকই। অভিযোগ, সারা বছর এ ধরনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে গিয়ে পড়ুয়াদের উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশের নীচেই থাকছে। এতে পরীক্ষা নিতেও সমস্যায় পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশপাশি কমছে, বই পড়ার অভ্যাস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক জানিয়েছেন, কাজ শেখা এবং নামমাত্র পারিশ্রমিকের আকর্ষণে পড়ুয়ারা ক্লাসে আসছেন না। যোগ নেই পাঠ্যক্রম বা পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে। অভিযোগ, পড়ুয়াদের বার বার বই পড়ার কথা বলা হলেও সাড়া পাওয়া যায় না।
তবে নতুন পদ্ধতির ইতিবাচক দিকটিকেও গ্রহণ করতে চাইছেন শিক্ষকদের অনেকে। যেমন আইআইটি, খড়্গপুরের অধিকর্তা সুমন চক্রবর্তী মনে করছেন এই পদ্ধতি আখেরে উন্নতি করবে আগামী প্রজন্মের। তাঁর কথায়, “এখনও পর্যন্ত নতুন শিক্ষানীতির সব নিয়ম কার্যকর করে উঠতেই পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠানে। চাহিদা অনুযায়ী, সেই বিধি প্রণয়ন করা গেলে পড়ুয়ারা কর্মমুখী ডিগ্রি কোর্সে করতে আরও আগ্রহী হবেন। হাতেকলমে কাজ শিখতে পারলে চাকরির ক্ষেত্রেও সেটা অনেক সুবিধা হবে।”