ছোট থেকে আর পাঁচ জনের মতো বইখাতা ধরে দেখতে পারলেও পড়ে দেখতে পারেননি। দৃষ্টিহীনতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। দোসর অর্থাভাব। কিন্তু এতরকম প্রতিকূলতা কোনওভাবেই তাঁর উচ্চশিক্ষার পথে তেমন বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। এ বছরের ইউজিসি নেট (ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন-ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট)-এ জেআরএফ (জুনিয়র রিসার্চ ফেলো) এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করেছন দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিতালি দেবনাথ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগরের মহিষঘাট গ্রামের বাসিন্দা মিতালি। মা-বাবা এবং এক বোন দৃষ্টিমান। কিন্তু তিনি এবং তাঁর দিদি দৃষ্টিহীন। ছোট থেকে কোনওদিন পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ হয়নি।
প্রথমে বেহালায় একটি দৃষ্টিহীনদের বিশেষ স্কুলে পড়াশোনা শুরু। এর পর বাকিদের সঙ্গে নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মণিপুর বাঁশতলা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৭০ এবং ৮০ শতাংশের বেশি। এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। ক্লাসে একমাত্র দৃষ্টিহীন পড়ুয়া হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান মিতালি। স্নাতক স্তর থেকেই অল্প অল্প করে শুরু করেন ইউজিসি নেট-এর পড়াশোনা। স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন ২০২৩ সালে। ২০২৪-এ প্রথম বারের জন্য নেট উত্তীর্ণ হন। কিন্তু সে বার একটুর জন্য জেআরএফ(জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ)-এর যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ২০২৫-এর জুন মাসে দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় লক্ষ্যভেদ করলেন মিতালি। পরীক্ষা দিয়েছিলেন বিশেষ ভাবে সক্ষম অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির নন ক্রিমি লেয়ার (পিডব্লিউডি ওবিসি এনসিএল) ক্যাটাগরিতে।
আরও পড়ুন:
কিন্তু এই যাত্রাপথ তো এত সহজ ছিল না। কেমন ছিল প্রস্তুতি? মিতালি বলেন, “আমি নেটের জন্য দিনে কোনও আলাদা সময় নির্দিষ্ট করে পড়িনি। যখন রবীন্দ্রভারতীতে পড়তাম, তখন ওখানকার একজন শিক্ষকের সাহায্য নিতাম। তার পর গ্রামে ফিরে এসে এখানকার একজন শিক্ষকের কাছে পড়তাম। কিন্তু টিউশন খরচটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই টিউশন ছেড়ে নিজেই একটু একটু করে প্রস্তুতি চালিয়ে যেতাম”। কোন উপায়ে? মিতালি জানান, ব্রেইলের মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে বই পড়েছি। আবার কখনও কোনও অ্যাপের মাধ্যমে শুনে শুনে পড়াশোনা করেছি। তবে এ ক্ষেত্রে বন্ধুদের ভূমিকাই সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কোনও বইয়ের কোনও অংশ রেকর্ড করে পাঠাতে হলে, বন্ধুরাই সেসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছে। সবসময় পাশে পেয়েছেন তাঁদের। পাশে থেকেছেন বাবা-মাও, আবেগতাড়িত গলায় জানান মিতালি।
শুধুই কি পড়াশোনা, আর কী পছন্দ তাঁর? মিতালির কথায়, “গান শুনতে, বই পড়তে খুব ভালবাসি। উপন্যাস এবং গোয়েন্দা গল্প খুব পছন্দের। ইংরেজি, বাংলা— দুইই। পছন্দের চরিত্র শার্লক হোমস এবং ফেলুদা।”
মিতালির বাবা একটি ছোট বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। তাই নিয়েই তিন মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে গিয়েছেন। উৎসাহ জুগিয়েছেন ক্রমাগত। শুধু অর্থনৈতিক না, মানসিক ভাবেও বরাবর মেয়েদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাই এ বার বাবার পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছে মিতালির। বর্তমানে বলরামপুরের একটি বিএড কলেজ থেকে বিএড পড়ছেন। নিচ্ছেন সরকারি পরীক্ষার প্রস্তুতিও। ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট ভাবে কোনও চাকরির ইচ্ছে নেই তাঁর। মিতালি বলেন, “আমার এখন একটাই স্বপ্ন যে কোনও ভাবে বাবার পাশে দাঁড়ানো। অর্থনৈতিক ভাবে সক্ষম হওয়া। তাই যে কোনও ভাবে চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরতে চাই।” তাই আপাতত একরোখা জেদ এবং অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে ভর করে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে মিতালি।