Advertisement
E-Paper

‘সব পাওয়ার নিশ্চয়তায় বাঁচি না’, শখের ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি কী ভাবে হয়ে উঠল অপরূপার পেশা?

লাদাখ থেকে সুন্দরবন, নেওড়া ভ্যালি থেকে সাতপুরার জাতীয় উদ্যান— অপরূপা দে-এর লেন্স খুঁজে বেড়িয়েছে বন্যপ্রাণীর না জানা কাহিনি।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০০

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

পূর্বস্থলীর চরে পাখি দেখার অপেক্ষায় বসেছিলেন পাঁচ ঘণ্টা। হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটে গেলে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। নবীন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার দেখলেন জলে সাঁতার কাটছে একটি গোসাপ, তাকে ঘিরে উড়ছে নীলাভ সবুজ রঙের বিশেষ প্রজাতির ফড়িং। শাটার টিপলেন, বন্দি হল মুহূর্ত। আর সেই ছবিই বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিল তাঁর— নদিয়ার অপরূপা দে।

প্রশ্ন: একটা ছবির জন্য পাঁচ ঘণ্টার অপেক্ষা! এত ধৈর্য আসে কী করে, কী ভাবেই বা প্রস্তুতি নেন এই স্নায়ুযুদ্ধের?

অপরূপা: জলে, জঙ্গলে ছবি তোলার মজাটাই এমন। যেমন ভেবে গিয়েছি, সে ভাবে যে ছবি আসবে— এই নিশ্চয়তায় বাঁচি না। নতুন কিছু হবে, নতুন কিছু পাবো, অপ্রত্যাশিত বাধা আসবে, হয়তো ক্লান্তও হয়ে পড়ব। কিন্তু প্রকৃতির রহস্য খুঁজতে গিয়ে যাতে থেমে না যাই, সেটারই চেষ্টা থাকে প্রতি বার। ছবি তোলাকে পেশা এবং নেশা বানাব বলেই এই লড়াইটার জন্য প্রস্তুত থাকি সব সময়।

পূর্বস্থলীর চর থেকে তোলা গোসাপের এই ছবিই ভবিষ্যৎ বদলে দেয়।

পূর্বস্থলীর চর থেকে তোলা গোসাপের এই ছবিই ভবিষ্যৎ বদলে দেয়। ছবি: অপরূপা দে।

প্রশ্ন: বন্যপ্রাণ আর চিত্রগ্রহণ— এ দু’টির প্রতি আগ্রহ তৈরি হল কী করে?

অপরূপা: আমার বাড়ি নদিয়ার তেহট্ট, সীমান্তবর্তী গ্রামে। অনেক গাছপালার মাঝে জন্ম। রংবেরঙের পাখি দেখতে ভালোবাসাতাম ছোটবেলা থেকেই। মা পাখি চিনিয়ে দিতেন মাঝে মাঝেই। ভালবাসার মধ্যেই বড় হয়েছি।

প়্রশ্ন: আপনার পড়াশোনা কি এই বন্যপ্রাণ বা ফোটোগ্রাফি নিয়েই?

অপরূপা: না। আমি পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়েছি। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি ছিল ছবি তোলার শখ। নিজের উৎসাহেই ছবি তুলতে শুরু করেছিলাম। একটু বড় হওয়ার পর বাবা আমাকে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। লেন্স আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী।

প্রশ্ন: প্রথাগত ভাবে ফোটোগ্রাফি শিখলেন কী ভাবে?

অপরূপা: প্রথমেই বলি, সেই অর্থে ফোটোগ্রাফিতে প্রথাগত শিক্ষা আমার নেই। নিজস্ব পড়াশোনার পাশপাশি মোবাইলে ছবি তুলতাম। পরে বাবার কিনে দেওয়া ক্যামেরাটাই ভরসা ছিল। নিজের ভাললাগা থেকেই এর সূচনা।

প্রশ্ন: কিন্তু ক্যামেরা চালনা করতে তো খানিকটা জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ফ্রেম থেকে আলো, শিল্পবোধের বাইরে কিছু প্রযুক্তি কৌশলও তো জানা প্রয়োজন?

অপরূপা: অবশ্যই। ভাল ছবি তুলতে গেলে শুধু শিল্পীর চোখ থাকলেই তো হবে না। প্রযুক্তিগত কৌশল আয়ত্ত করতেই হয়। লেন্সের মধ্যে দিয়ে ছবির বিষয় কী ভাবে খুঁজে নিতে হবে তা শিখতে হয় হাতেকলমে। আমি বিভিন্ন খ্যাতনামী স্থিরচিত্রগ্রাহকদের লেখা বই পড়েছি। ইন্টারনেটের সাহায্যও নিয়েছি কখনও কখনও। এখনও পড়াশোনা করি ফোটোগ্রাফি নিয়ে। নিজে নিজে পড়ি। নতুনদেরও উৎসাহ দিই, যাতে শূন্য থেকে শুরু করতে পারেন তাঁরাও।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কেন এই পেশায় আসবেন? শুধু শখ তো নয়, পেশা হিসাবে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি কতখানি প্রতিষ্ঠা দিতে পারে?

অপরূপা: ছবি তোলা যে পেশা হতে পারে, দীর্ঘ দিন মানুষ সেটা বিশ্বাসই করতে পারেননি, বিশেষত বন্যপ্রাণের ছবি তোলা। এখন সেই ধারণা অনেকটা বদলেছে। ভাল ছবি তুলতে পারলে কাজ পাওয়া যেতে পারে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায়। তবে এটা তো সৃজনশীল পেশা, তাই নিজেকে সব সময় তৈরি রাখতে হয়। কখনও সন্তুষ্টির কোনও জায়গা নেই।

প্রশ্ন: তরুণ কোনও চিত্রগ্রাহক কী ভাবে আবেদন করতে পারেন বিভিন্ন সংস্থায়?

অপরূপা: বিভিন্ন ক্যামেরা প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের নিজস্ব প্রকল্পের কাজে চিত্রগ্রাহকদের নিয়োগ করে থাকে। এ ছা়ড়া বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিত্রগ্রাহক নিয়োগ করতে পারে। বন দফতরের নিজস্ব চিত্রগ্রাহক থাকেন, সেখানেও আবেদন করা যেতে পারে।

তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই কাজ হয়ে থাকে চুক্তিভিত্তিক। তার একটা ভাল দিক অবশ্যই স্বাধীনতা। নিজের মতো কাজ করার সময় থাকে হাতে।

বন্য গন্ধগোকুল-এর ছবি সাহস যুগিয়েছিল।

বন্য গন্ধগোকুল-এর ছবি সাহস যুগিয়েছিল। ছবি: অপরূপা দে।

প্রশ্ন: আপনি কী ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন?

অপরূপা: সমাজমাধ্যম থেকে খুব সাহায্য পেয়েছিলাম। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আমার তোলা পাখি এবং অন্য প্রাণীর একাধিক ছবি দেখে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার পর থেকে ওই সংস্থার হয়েই ভারতে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে একাধিক প্রকল্পে কাজ করেছি। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও নতুন প্রজাতির অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছে, এমন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও বেশ কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছে আমার।

প্রশ্ন: যাঁরা লেন্সের মধ্যে প্রকৃতিকে দর্শন করতে চান, এই কাজটিকে পেশা বানাতে চান? তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?

অপরূপা: যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, নিজের চোখে দেখা কাহিনিকে লেন্সের মধ্যে দিয়ে সাজাতে চান, তাঁরা নিজের ঘরে বসেই তা করতে পারেন। বাড়ির উঠোন কিংবা ঝোপেঝাড়েই প্রকৃতির আশ্চর্য জগৎ লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকেই খোঁজ শুরু করা যায়। লেন্সে তাদের ধরতে পারলে পরের পথটা সহজ হয়ে যায়।

প্রশ্ন: মেয়ে হয়ে লেন্স হাতে ছবির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরার জীবন, কটাক্ষ শুনতে হয়েছে?

অপরূপা: প্রথম দিকে যখন আত্মীয়-প্রতিবেশীরা জানতে পেরেছিলেন— তাঁরা একবাক্যেই বলেছিলেন, “ফোটোগ্রাফি করে কী হবে? ওতে কোনও ভবিষ্যৎ নেই।”

কিন্তু পরে আমার তোলা ছবি দেখে তাঁরাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উপরন্তু বিলুপ্ত পাখি বা প্রাণী সংরক্ষণের যে বার্তা আমি দেওয়ার চেষ্টা করি, তাতে উৎসাহ পেয়ে বাচ্চাদেরও শেখান অনেকেই। বেআইনি প্রাণী পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমার তোলা ছবি অনুপ্রেরণা দেয় সকলকে, সেটাই আমার প্রাপ্তি।

প্রশ্ন: মেয়ে বাড়ির বাইরে রাতের পর রাত কাটায়, মা বাবার চিন্তা হয় না?

অপরূপা: একা একা গাইডের ভরসায় জঙ্গলে যাওয়া, মাঝরাতে অচেনা স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা কিংবা কাকভোরে অন্ধকারে ভয়ঙ্কর প্রাণীর সাইটিং— সবটাই চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য তো হাজার বাধা। দুশ্চিন্তা তো থাকবেই। ২০১৬ থেকে কাজ করছি। আমার মা বাবা এখনও রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন, কিংবা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর খোঁজ নেন। এক সময় মা আমার সঙ্গে সাইটিং-এর জন্যও যেতেন। কিন্তু পরে আমিই একা একা যাওয়া শুরু করি।

প্রশ্ন: লাদাখ থেকে নেওড়া ভ্যালি, বিপদের আভাস সর্বত্র! একা যেতে ভয় করেনি?

অপরূপা: সত্যি বলতে ভয় করলেও অবোলা প্রাণীদের কথা ভেবে সেটা কেটে গিয়েছে। যখন দেখতাম বৈদ্যুতিক খুঁটিতে টিয়াপাখি বসে আছে, তখন মনে হত আজ যদি ওই জায়গায় গাছ থাকত, তা হলে ওর জীবনটাও সহজ হত। একটা আশ্রয় পেত। লাদাখে যেমন তিব্বতি নেকড়ে, লাল শেয়াল, পালা’স ক্যাট-এর মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির দেখা পেতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। উচ্চতা যত বেড়েছে, তত অসুস্থ হয়েছি। কিন্তু ওদের দেখা পেতেই সব কষ্ট ভুলে গিয়েছি।

প্রশ্ন: দেশ বিদেশের জীববৈচিত্র্য ধরা পড়ে আপনার ক্যামেরায়, শুরু কী ভাবে?

অপরূপা: স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার সময়ই সমাজমাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট করেছিলাম। ঘরের লক্ষ্মীপ্রতিমার পাশে বন্য গন্ধগোকুল। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণী প্রায়ই দেখা দেয় আমাদের এলাকায়। তাকে দেখামাত্রই ছবি তুলে, তার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করি। উদ্দেশ্য ছিল সচেতনতা প্রচার। ওই ছবিটি দেখে বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হন, এবং আমিও সিদ্ধান্ত নিই জীবনটাকে অন্য ভাবে শুরু করব।

ছবি: অপরূপা দে।

প্রশ্ন: এখন তো জীবন বদলে গিয়েছে, বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হয় দিনের পর দিন। উৎসবে-অনুষ্ঠানে ফিরতে না পারলে মনখারাপ হয়?

অপরূপা: গত কয়েক বছর দুর্গাপুজোয় বাড়ি ফিরতে পারিনি। খুবই কষ্ট হয়েছে। পাড়ার পুজো, আলোর চাঁদোয়া, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া— সবই আমার খুব পছন্দের। কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই সেগুলো বাদ পড়ে যায় জীবন থেকে। পেশাগত কারণেই যায়। তখন আমি গান শুনি। আকাশে মেঘের আনাগোনা, জঙ্গলের ঋতু পরিবর্তন, পশু পাখিদের ডাক আমাকে জানিয়ে দেয় উৎসব শুরু হয়েছে। আমি অন্য এক উৎসবে মাতি।

প্রশ্ন: এর পর কোথায় হানা দেবে আপনার লেন্স?

অপরূপা: মধ্যপ্রদেশের সমস্ত জাতীয় উদ্যানে আমার পরবর্তী সফর হতে চলেছে। ‘প্রজেক্ট চিতা’-র জন্ম সেখানেই। ওই এলাকায় ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর দ্রুততম পশুকে চাক্ষুষ করতে চাই। একটা একটা করে প্রাণীর জীবনকে লেন্সবন্দি করা, ওদের কাহিনি সকলকে জানানোই আপাতত আমার আগামী দিনের লক্ষ্য।

nature photography Career Advice Expert Interview
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy