অর্থমন্ত্রী কথা রেখেছেন। আগেই বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী বাজেটে চমক থাকবে না। সেই অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার নির্মলা সীতারামন সংসদে যে বাজেট পেশ করলেন তা সত্যিই চটকহীন। স্পষ্ট বার্তা, ভোটে জেতার ব্যাপারে তাঁরা এতটাই নিশ্চিত যে, মানুষের মন পেতে একে ব্যবহার করার দরকার নেই। এতে অবশ্য সাধারণ মানুষ বেশ হতাশ। ২০১৯ সালের অন্তর্বর্তী বাজেটে যেহেতু মোদী সরকারই কর সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল, তাই এ বারও অপেক্ষা করে বসেছিলেন অনেকে। শিল্পমহলও আশাবাদী ছিল। যে কারণে তারাও দাবি-দাওয়া জানিয়েছিল সরকারকে। তবে নির্মলা সেই পথে হাঁটেননি।
এমনিতে ভোটের খাতিরে ‘জনমোহিনী’ প্রস্তাব দিয়ে বাড়তি খরচের পথে না হাঁটা শেয়ার বাজারের একাংশকে খুশি করেছে। নির্মলার বার্তায় ভোটে জিতে আসার ‘আত্মবিশ্বাস’-কে স্থায়ী সরকার গঠনের ইঙ্গিত হিসেবে ধরেও নিশ্চিন্ত তারা। তবে অন্য অংশ কিছুটা হতাশ হয়েছিল সে দিন। তাই সূচক ওঠানামা করতে থাকে এবং দিনের শেষে ১০৭ পয়েন্ট হারায় সেনসেক্স।
বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণের পরে অবশ্য বাজারের চেহারা পাল্টে যায় শুক্রবার। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় একগুচ্ছ সদর্থক সঙ্কেত খুঁজে পেয়ে এক সময় সেনসেক্স ১৪৪৪ পয়েন্ট বেড়ে ৭৩,০৮৯ ছোঁয়। নজির গড়ে নিফ্টি-ও। পরে বিক্রির চাপ আসায় নামে। শেষে বৃহস্পতিবারের থেকে ৪৪০ পয়েন্ট উঠে সেনসেক্স থিতু হয় ৭২,০৮৬ অঙ্কে। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, অন্তর্বর্তী বাজেটে চমক না থাকলেও সরকারের পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতি দৃঢ় প্রত্যয়ে এগোবে। আরও তেজি হবে বাজার। বাজেটের যে সব প্রস্তাব লগ্নিকারীদের ভাল লেগেছে, সেগুলি হল—
- লোকসভা ভোটে জিতে শাসকদলই ক্ষমতায় ফিরবে বলে সরকারের প্রত্যয়। সে ক্ষেত্রে দেশ ফের পাঁচ বছরের মজবুত সরকার পাবে এবং সরকারের কাজের ও পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
- পরিকাঠামোয় বরাদ্দ ১১% বাড়িয়ে ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা করা। এর সুফল পাবে বিভিন্ন শিল্প।
- আগামী অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৫.৮% থেকে ৫.১ শতাংশে নামিয়ে আনা। এতে বাজার থেকে সরকারকে কম ধার করতে হবে।
- প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় আরও পরিবারের সংযুক্তি। এত বাড়ি তৈরি হলে উপকৃত হবে নির্মাণ শিল্প এবং তার সহায়ক নানা ক্ষেত্র।
- বস্তিতে এবং ভাড়ায় থাকা নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের মাথায় সস্তার ছাদ।
বাজেট প্রস্তাবগুলি দেখে নিয়ে বাজার এরই মধ্যে অঙ্ক কষে নিয়েছে এবং সেই মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছে বিভিন্ন শেয়ার। যেমন—
- বাজেট ঘাটতি কমলে সরকার ঋণপত্র (বন্ড) ছেড়ে বাজার থেকে কম ধার নেবে। বন্ডের জোগান কমবে ধরে নিয়ে তার দাম বাড়তে শুরু করেছে। ফলে শুক্রবার বন্ড ইল্ড বা প্রকৃত আয় নেমে এসেছে ৭.০৫ শতাংশে। বন্ডের দাম বাড়ায় দ্রুত মাথা তুলেছে বিভিন্ন সরকারি ব্যাঙ্কের শেয়ারের দাম। এই ব্যাঙ্কগুলিই বন্ডে বেশি লগ্নি করে।
- পরিকাঠামো শিল্পতে বিপুল পরিমাণ সরকারি লগ্নির প্রস্তাবে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে ইস্পাত এবং সিমেন্ট সংস্থাগুলির শেয়ার।
- আবাস যোজনা এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্যে আস্তানার প্রস্তাবে সামনে ভাল দিন দেখছে গৃহঋণ এবং জমি-বাড়ি সংক্রান্ত সংস্থাগুলি। এই প্রস্তাবেরও সুফল পাবে ইস্পাত, সিমেন্ট শিল্পে।
- সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার মদত দেবে, এই প্রস্তাবে চাঙ্গা সংশ্লিষ্ট ডজন খানেক সংস্থা।
তবে শুধু শেয়ার বাজার নয়, এ বছর বন্ডের বাজারও ভাল থাকবে বলে আশা। এরই মধ্যে বন্ডের দাম বেশ খানিকটা বেড়েছে। ভারত এবং আমেরিকায় সুদ কমতে শুরু করলে আরও বাড়বে। পড়বে ইল্ড। এতে সরকার এবং বন্ড ইসুকারী সংস্থাগুলির লাভ হবে। বাড়বে বন্ড ফান্ড এবং ব্যালান্সড ফান্ডের ন্যাভ।
মোদ্দা কথা, আপাতদৃষ্টিতে এই বাজেটে তেমন চমক না থাকলেও শেয়ার বাজার, বন্ড এবং ফান্ডে লগ্নিকারীদের জন্যে অনেক কিছুই আছে। এ বার দেখার, সম্ভাবনাগুলি বাস্তবে কার্যকর হয় কি না বা কতটা হয়। কারণ, অর্থনীতি এবং লগ্নিকারীর লাভ নির্ভর করবে তার উপরে। বাজারের আশা জুলাইয়ের পূর্ণাঙ্গ বাজেট থেকে বাজার সহায়ক আরও অনেক কিছু পাওয়া যেতে পারে কেন্দ্রে শক্তিশালী নতুন সরকার গঠিত হলে।
(মতামত ব্যক্তিগত)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)