—প্রতীকী ছবি।
বিকেলের মুখে, সবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। গদখালিতে বিদ্যাধরী নদীর আকাশে তখনও মেঘ। নিরাপত্তারক্ষী এবং ভোট-কর্মীরা নদীর ও-পারে গোসাবায় প্রবীণ নাগরিকদের বাড়ি, বাড়ি গিয়ে ভোট নেওয়ার কাজ সেরে বাসন্তীর দিকে ফিরছেন।
নদীর ঘাট লাগোয়া দোকানে বসে কথা হচ্ছিল বাসিন্দা উত্তম গায়েনের সঙ্গে। নদীর ফুলে ওঠা জলের দিকে তাকিয়ে উত্তম বলছিলেন, ‘‘কালো মেঘ জমতে দেখলে অজান্তে হাতের মুঠো ও চোয়াল শক্ত হয় সুন্দরবনের মানুষদের। অসম শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ের জেদ তাঁদের মজ্জাগত।’’
তবু, বিপদ তো আচমকাই আসে। ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর। কথায় কথায় ভোটের প্রসঙ্গ এলে নিজেই বললেন, ‘‘বন্যার দাপট তো চোখে দেখা যায়। কিন্তু, চোরা স্রোতে নদীবাঁধের অজান্তে ক্ষতি হয় বেশি। পরে বড় বিপদ সেখানেই ঘনায়।’’
এ বারও ভোটের আপাত শান্ত হাওয়ার মধ্যে আশঙ্কার গন্ধ পাচ্ছেন উত্তমের মতো অনেকেই।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মেরুকরণের প্রবল হাওয়ার মধ্যেও রাজ্যের শাসক দলের প্রার্থী এই আসনে ৩ লাখ ১৬ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে এই লোকসভা আসনে তৃণমূলের এগিয়ে ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ভোটে। গোসাবা, বাসন্তী, জয়নগর, কুলতলি, ক্যানিং পূর্ব ও পশ্চিম এবং মগরাহাট পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে তৈরি এই আসনে সর্বত্রই তৃণমূল এগিয়ে। যদিও গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের একতরফা দাপটে মানুষের মনে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। আছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাও।
এ বারে জয়নগরে বিজেপি প্রার্থী করেছে এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত অশোক কান্ডারীকে। আগেও তিনি এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি ও তৃণমূল-বিরোধিতা— দুটোই অস্ত্র বিজেপির। গ্রামে, গঞ্জে ছুটছেন অশোক।
তিন লাখের উপরের ব্যবধান কতটা কমাতে পারবেন? অশোক বলেন, ‘‘মানুষ ভোট দিতে পারলে ইভিএমে ক্ষোভ উগরে দেবে। ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্রে গত বার লাখের উপরে লিড পেয়েছিল তৃণমূল। এ বার বিশেষ বাহিনী থাকবে। কারচুপি করা সহজ হবে না।’’ কিন্তু ২০১৯, ২০২১-এ তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতেই ভোট হয়েছে, তা হলে? সদুত্তর মেলেনি।
তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মণ্ডল রাজ্য সরকারের প্রাক্তন আমলা। লোকসভা এলাকায় গুঞ্জন, এলাকার বিধায়কদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘মধুর’। যদিও, প্রচারে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিধায়করা থাকছেন। দলের তরফে প্রচারে সংঘবদ্ধ চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে।
প্রতিমার লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ তহবিল দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা পরিষদ সদস্য খান জিয়াউল হক। তিনি প্রচারেরও দায়িত্বে। লোকসভা কেন্দ্রের খুঁটিনাটি তাঁর নখদর্পণে। হিসেব দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, গত লোকসভা নির্বাচনের চেয়েও ব্যবধান বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কী ভাবে ছুটছেন তাঁরা। বিশেষ করে যে সব জায়গায় বিজেপি ব্যবধান বাড়ানোর কথা ভাবছে। দু’বারের সাংসদ প্রতিমা নিজেও প্রচারে তুলে ধরছেন, কী ভাবে তিনি এলাকার বিষয়গুলি নিয়ে সংসদে সরব হয়েছেন, সেই কথা।
মগরাহাট-পূর্ব কেন্দ্রের যুগদিয়া বাজারে এক চায়ের দোকানে স্থানীয় মানুষজন জানাচ্ছিলেন, দলের বিধায়ক এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর থেকে দূরত্ব রাখেন প্রতিমা। সেটাই তাঁর ‘প্লাস পয়েন্ট’। তাঁরা বলেন, তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের যে সব ‘কার্যকলাপ’ নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, তার কিছুই প্রতিমার বিরুদ্ধে খাটে না। বরং তাঁর ব্যবহার সহজ। তাই গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
তবে, কেন্দ্রে সমস্যা কি নেই ? স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সুন্দরবন এলাকায় বড় সমস্যা। গোসাবা এখনও দুর্গম, সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহও স্বাভাবিক নয়। বাসন্তী এবং গোসাবার মধ্যে কেন যোগাযোগের সুব্যবস্থা করা গেল না, সেই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। মাতলা নদীর উপর স্তম্ভ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেও ক্যানিং-বাসন্তী-ঝড়খালি রেলপথ কেন করা গেল না, প্রশ্ন উঠছে। এই নিয়ে আন্দোলন করছে সুন্দরবন নাগরিক মঞ্চ। মঞ্চের সভাপতি লোকমান মোল্লা বলেন, ‘‘কেন্দ্র-রাজ্য দায় ঠেলাঠেলি করে। কাজ এগোয় না।’’
প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর বলেন, ‘‘বাম সরকারের সময় সেতু নির্মাণের জমি জোগাড়ের ক্ষেত্রে যে তৎপরতা ছিল, এখন তা নেই। ফলে, কাজ এগোচ্ছে না।’’ মানুষের মনে ক্ষোভ গদখালি এবং গোসাবার মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ না হওয়া নিয়েও।
রাজ্য সরকার এখন ওই অংশে নদীর দু’পাশে পন্টুন জেটি গড়েছে। তাতে আংশিক সুরাহা হলেও, স্থানীয়েরা বলছেন, সেতুর বিকল্প নয়।
এই কেন্দ্রে এ বারের আরএসপি প্রার্থী সমরেন্দ্র মণ্ডল। বামেরা নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ধরে ছোট ছোট সভা, মিছিল করছেন। সুভাষ নস্করের কথায়, ভোট ধরে রাখাই লক্ষ্য তাঁদের। যাতে, বিধানসভা নির্বাচনে লড়াইয়ের জমি বাড়ানো যায়।
এসইউসি প্রার্থী নিরঞ্জন নস্কর দলের যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি। আইএসএফ প্রার্থী মেঘনাদ হালদারও রয়েছেন ভোট ময়দানে। তবে, তাঁদেরও লক্ষ্য ভোট ধরে রাখা। গত বিধানসভা ভোটে ক্যানিং পূর্বে কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে ছিল আইএসএফ।
বিরোধীদের এই ছন্নছাড়া অবস্থাকেই প্রচারকে হাতিয়ার করছে শাসকদল। এই কেন্দ্রের প্রায় ৫৫ শতাংশ ভোটার তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু। ওই ভোটের অধিকাংশ পেলেই পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট ঘরে আসবে বলে মনে করছেন শাসকদল। তবে, ফুটোফাটাও আছে। তাই নিজের বাঁধ মজবুত করতেই নজর তৃণমূলের। অন্যদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy