Advertisement
E-Paper

অর্জুন বনাম পার্থের মহাভারতে মন্ত্র জনসংযোগ

মহাভারতে যিনি পার্থ তিনিই অর্জুন। কিন্তু ব্যারাকপুরের মিনি ভারতে পার্থ আর অর্জুন সম্মুখসমরে। আগামী সোমবার ভোট হবে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে। সাংসদ বনাম মন্ত্রীর লড়াই।

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৪ ০৭:৩৭
Representative Image

—প্রতীকী ছবি।

বড়ই ধর্মসঙ্কটে পড়েছেন আটাত্তরের সুভাষ সরকার। আজীবন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে গঙ্গাপারের ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে এমন কোনও বড় মিটিং-মিছিল হয়নি, যাতে তিনি অনুপস্থিত। ভাটপাড়ার বাসিন্দা সুভাষের কাছে অর্জুন সিংহ সব সমস্যার ত্রাতা। কিন্তু দল বদলে অর্জুন আবারও বিজেপিতে। সুভাষের চিন্তা, ভোট দেবেন কাকে? সুভাষের কথায়, ‘‘ব্যারাকপুরে দলটা বেশ চলছিল। এক দিকে অর্জুন, অন্য দিকে পার্থ (পার্থ ভৌমিক, তৃণমূল প্রার্থী)। অর্জুনকে দল কেন যে টিকিটটা দিল না! উনি যেমন সাংসদ ছিলেন, থাকতেন। আমাদের ভোট দিতে গিয়ে এত দ্বিধায় পড়তে হত না।’’

সুভাষের মতোই চিন্তিত নৈহাটির শিবদাসপুর এলাকার জীবন দাস। একই ধর্মসঙ্কট তাঁর জীবনেও। আজীবন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদর্শে বিশ্বাসী। দেশভাগ থেকে দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য কংগ্রেসকে মনে মনে তুলোধোনা করেন তিনি। বিশ্বাস করেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর পরে দেশের সেরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৯-এর আগে দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা অর্জুনের কোপে কত বিজেপি কর্মী মার খেয়েছেন, এলাকা ছাড়া হয়েছেন! গত নির্বাচনের ওঁর দাঁড়ানো, তৃণমূলে ফেরা এবং এ বার ফের বিজেপির প্রার্থী! এ তো শুধু ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া, মানুষেরইচ্ছেকে নয়।’’

মহাভারতে যিনি পার্থ তিনিই অর্জুন। কিন্তু ব্যারাকপুরের মিনি ভারতে পার্থ আর অর্জুন সম্মুখসমরে। আগামী সোমবার ভোট হবে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে। সাংসদ বনাম মন্ত্রীর লড়াই। বিদায়ী সাংসদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বলেছেন, ‘‘পদ্ম চিহ্নে পড়া প্রতিটি ভোট যাবে মোদীর কাছে।’’ জনতা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে।

বিধায়ক তথা মন্ত্রী পার্থর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কথা-কবিতায় মনে করিয়েছেন, এই শিল্পাঞ্চল বার বার অশান্ত হওয়ার বিষয়টি। লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী ছাড়াও রেশন থেকে রাস্তা, জল থেকে পড়ুয়াদের স্মার্ট ফোন— রাজ্য সরকারের ভূমিকার কথা। জনসভায় পার্থর হাত তুলে ধরে জেতানোর আর্জি জানিয়েছেন আম জনতার কাছে। অর্জুন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘ডেঞ্জারাস! দ্বিতীয়বার যখন তৃণমূলে এল, ভেবেছিলাম বদলেছে নিজেকে। ভুল ভেবেছিলাম। কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’’ অর্জুন কি তৃণমূলে ফিরেও বিজেপির সঙ্গে সখ্য বজায় রেখেছিলেন? নইলে আবারও শেষ মুহূর্তে দল ছেড়ে গিয়ে টিকিট পেলেন কী করে— এ প্রশ্নও উঠেছে তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে।

বড় শিল্প, বিশেষত চটশিল্পে ভাটা পড়েছে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বহু দিন। দিশাহীন বাজারের কারণে। ক্রমশ, জনবসতি বাড়লেও কল-কারখানায় শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বরং স্কুল পড়ুয়া থেকে বৃদ্ধ, রোজগারের বিকল্প পথ হিসাবে জমির দালালিতে নিজেদের ব্যস্ত করেছেন। কারণ, বাইরে থেকে আসা বহু মানুষের ব্যারাকপুরকে ঘিরেই মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই যে! বড় শিল্পের কারখানায় ছোট ছোট শিল্প ও গুদাম গজিয়ে উঠেছে। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, চায়ের ঠেকে ভোট নিয়ে বিতর্ক, ট্রেনে-বাসে প্রার্থীদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের যে ছবিটা সবাই দেখতে অভ্যস্ত, সেটা উধাও হয়েছে। একান্তেও ব্যস্ততার জায়গা নিয়েছে মোবাইল। ফলে বহু পরিমাণে পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন আর প্রার্থীর প্রচারটুকু ছাড়া এই শিল্পাঞ্চলে ভোটের দামামা সে ভাবে বাজেনি এ বার।

লোকসভা নির্বাচন আর ব্যারাকপুর— এই দুইয়ের মাঝে তড়িৎবরণ তোপদার নামটা প্রাসঙ্গিক আজও। পাঁচ বারের সাংসদ। ২০০৪ সালে তাঁর সঙ্গেও এক বার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গিয়েছিলেন অর্জুন। লক্ষ্যভেদ হয়নি। এ বার ভোট প্রচার শুরু করেছেন তাঁর বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে। পার্থও গিয়েছিলেন। দু’জনকেই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক। এক দিন দুপুরে ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন বিদ্যাভবনে সিপিএম প্রার্থী দেবদূত ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘ত্রিমুখী লড়াই হলে আমাদের প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা প্রবল। আর যদি পোলারাইজ়ড হয়, তবে অর্জুনের পাল্লা কিন্তু হালকা নয় মোটেই। খেয়াল রাখতে হবে।’’

ভোট এ বার তলায় তলায় হয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছেন এলাকাবাসী। এই লোকসভার সাতটি বিধানসভার প্রায় সমস্ত পুরসভা ও পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সব ক’টি থেকে লিড চেয়েছেন পার্থ। অর্জুন-ঘনিষ্ঠ বলে তৃণমূলের যে নেতারা পরিচিত, এই এলাকায় তাঁদের সঙ্গে একক ভাবে বৈঠক করেছেন, প্রস্তাব দিয়েছেন ভবিষ্যতে আরও ‘সুদিন’ আনার। তৃণমূলের প্রচারেও নেতারা নাগাড়ে বলে চলেছেন, ব্যক্তি সম্পর্ক থাকুক বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে, কিন্তু দল আগে— এই আপ্তবাক্য মানতে হবে। নইলে সংসদে নিজেদের দাবি তুলে ধরার উপায় থাকবে না। ছেড়ে আসা দলের অন্দরের চোরাস্রোতকে কাজে লাগাবেন অর্জুন, এ তো দাবার চাল। বাকি জমি তো তিনিও তৈরি করেছেন গত পাঁচ বছরে। বিভিন্ন জায়গায় মেলা, খেলা, তুমুল জনসংযোগে ভর করে ভোট বাজারে বলেছেন, ‘‘বাহুবলী বলা হয় আমাকে। বাহু নয়, মানুষের বলে বলীয়ান আমি। সবার পাশে আছি। মানুষ আমাকে দেখে ভোট দেবেন, দল দেখে নয়।’’

ভোট বাজারে পার্থর ইউএসপিও জনসংযোগ। বুদ্ধিদীপ্ত, মার্জিত, সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রবল। নিজের লোকসভায় দলের অন্দরের এলোমেলো হাওয়া সামাল দিতে শেষ প্রচারের ফাঁকেও ছুটছেন অবিরত। বলছেন, ‘‘কোনও খামতি তো রাখিনি পরিশ্রমে, সবার পাশে থাকতে চাইছি আগামী দিনেও। বাকিটা অপেক্ষা।’’

Lok Sabha Election 2024 Barrackpore TMC BJP Partha Bhowmik Arjun Singh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy