মঙ্গলকোটে সিপিএমের দেওয়াল লিখন। —নিজস্ব চিত্র।
এ বারের নির্বাচনটা আমাদের ক্ষেত্রে অনেক সহজ হয়ে গেল। রাজনীতিতে আমি দীর্ঘ দিন আছি। বহু নির্বাচন দেখেছি। বহু রকমের লড়াই করেছি। কখনও খুব কঠিন লড়াই, কখনও অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এ বার বিধানসভা নির্বাচনের যে গতিপ্রকৃতি দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, এ বারের লড়াই সবচেয়ে সহজ। কংগ্রেস এবং বামেরা যে জোট গড়েছে তা আমাদের লড়াইকে আরও সহজ করে দিয়েছে। মানুষের কাছে বার্তা গিয়েছে, এটা একটা স্বার্থান্বেষী জোট। দুই দলের আদর্শ পরস্পরের সঙ্গে মেলে না। নীতিতে যোজন যোজন ফারাক। তবু, জোট। তেল ও জল কি মিশতে পারে কখনও?
গ্রামবাংলায় এখন একটা প্রশ্ন উঠছে। বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সুবিধাবাদী জোট নিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। প্রশ্ন হল, কী হবে কংগ্রেস আর সিপিএমের যৌথ স্লোগান? সিপিএম কি বন্দে মাতরম বলতে পারবে? নাকি কংগ্রেসিরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলবে? আমার এক নবাবের কথা মনে পড়ছে। সেই নবাব বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয় চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, হিন্দুরা পুজো করে। আর মুসলমানেরা নমাজ পড়ে। এই দুটো মিলিয়ে একটা অভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি চালু করতে চেয়েছিলেন সেই নবাব। পূজা আর নমাজ মিলিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন পূমাজ। কিন্তু, সেই উপাসনা পদ্ধতি সাধারণ মানুষ মেনে নেননি। কংগ্রেস-সিপিএম জোটেরও সেই দশাই হতে চলেছে। হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার অপরাধে হাত কেটে নিয়েছিল সিপিএম, সেই হাত আজ কাস্তে ধরছে! এটা কি সাধারণ কর্মীরাও ভাল ভাবে নেবেন? কিছুতেই না। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলার সব ধরনের বামবিরোধী মানুষের সমর্থন আমরা পাব। উন্নয়ন যেমন আমাদের এগিয়ে দিয়েছে, এই জোটও তেমন আমাদের অনেক এগিয়ে দিয়েছে।
অধীর চৌধুরীকে দেখে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কথা মনে পড়ছে। কথিত আছে, আলিবর্দি খাঁর বখাটে নাতি সিরাজ নবাব হয়েই বলেছিলেন, পড়া না পারার জন্য যে মাস্টার আমাকে শাস্তি দিয়েছিল তাকে আগে ডেকে নিয়ে আয়। ওকেই আগে কোতল করব। তাই করেওছিলেন। সিরাজের স্বৈরাচারের কারণেই মুর্শিদাবাদের নবাবি রাজত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজদের কাছে বিকিয়ে গিয়েছিল বাংলা। অধীর চৌধুরীও নিজেকে মুর্শিদাবাদের নবাব ভাবছেন। আর নিজের মুর্শিদাবাদের গড় অক্ষত রাখতে গোটা বাংলার কংগ্রেসকে সিপিএমের কাছে বিকিয়ে দিচ্ছেন। কংগ্রেসকে অধীর সিপিএমের কাছে বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন।
এ বার আসি আমার নিজের বিধানসভা কেন্দ্রের কথায়। পিংলা থেকে লড়ছি। আমি মেদিনীপুরের মানুষ। এখানেই বড় হওয়া, পড়াশোনা, কর্মজীবন। দুই মেদিনীপুরের সব বিধানসভা কেন্দ্রই আমার নিজের এলাকা। পিংলায় এসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালবাসা পাচ্ছি। পিংলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কখনও জাতীয়তাবাদী প্রার্থীরা নির্বাচিত হননি। বহু বছর ধরে এই আসন বামেদের হাতে। তাই মানুষ চাইছেন, বামেদের হাত থেকে মুক্তি পেতে। আর এখানে যে বাম দল প্রার্থী দেয়, সে তো নেহাতই ছোট একটা দল, ডিএসপি। এই দলের এক জনই মাত্র বিধায়ক। দলের কোনও নির্দিষ্ট প্রতীকও নেই। গত বছর ধামসা-মাদল চিহ্ন নিয়ে ভোটে লড়েছিল। এ বছর হাত-হাতুড়ির মিলন দেখে কী মনে হয়েছে জানি না, পালতোলা নৌকো নিয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
এ সব ছোট দলের নেতারা গ্রামবাংলার এই সব আসন থেকে জিতে কলকাতায় চলে যান। আবার পাঁচ বছর পরে ভোটের সময়ে নিজের কেন্দ্রে ফেরেন। মাঝখানে তাঁদের দেখা মেলে না। গোটা পিংলায় ডিএসপি দলের নির্দিষ্ট কোনও একটা অফিস নেই। সাধারণ মানুষ প্রয়োজনে বিধায়কের সঙ্গে দেখা করবেন কী ভাবে, কোথায় গেলে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ হবে, তা কেউ জানেন না। হাসপাতাল, পঞ্চায়েত, বিডিও— এ রকম বিভিন্ন সরকারি অফিসে জনপ্রতিনিধির সুপারিশ নিয়ে হাজির হতে হলে, কার দ্বারস্থ হতে হবে পিংলার মানুষ জানেন না। এমন দল এবং এমন বিধায়কের হাত থেকে পিংলা এ বার মুক্তি পেতে বদ্ধপরিকর।
মুকুল রায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন জনসভা করতে। বেলা একটার সময় খাঁ-খাঁ রোদ্দুরে যে পরিমাণ ভিড় হল, তা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন আমরা কতটা এগিয়ে। রোজ পদযাত্রায় বেরোচ্ছি। রাস্তায় বেরিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। ভালই বুঝতে পারছি, আমাদের প্রতি মানুষের সমর্থন এ বার কতটা স্বতস্ফূর্ত। সে দিন মিছিলের ফাঁকে এক ভদ্রমহিলার দিকে হাতজোড় করে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ভোটটা দেবেন তো?’’ তিনি আমার হাত দু’টো ধরে বললেন, ‘‘কোনও সরকার মহিলাদের জন্য যে ভাবে, সেটা তো এই প্রথম দেখছি। আমার মেয়েটা স্কুলে যাবে কী করে, সেটা ভেবে সরকার আমার মেয়েকে একটা সাইকেল দিয়ে দিল। এ তো আগে কখনও দেখিনি বাবা! ভোট তো দিতেই হবে!’’ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মধ্যে তৃণমূলের প্রতি এই উজাড় করা সমর্থন দেখতে পাচ্ছি। হয়তো ২৯৪টা আসনে জিতব না। কিন্তু, ২০১১-র চেয়েও অনেক বেশি আসন নিয়ে আমরা ক্ষমতায় ফিরছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy