Advertisement
E-Paper

উন্নয়নের কোনও ট্রেনই আসলে এসে পৌঁছয়নি পরিবর্তনের নন্দীগ্রামে

গোধূলির আলো এসে পড়েছে স্টেশনে।লালচে লাগছে প্ল্যাটফর্ম দুটোকে, যেমন লাগে। রয়েছে লোকজনের আনাগোনা, যেমন হয়। দু’পাশ জুড়েছে একটা ওভারব্রিজ, যেমন জোড়ে। আছে একটা টিকিট কাউন্টার, যেমন থাকে। রয়েছে স্টেশনে ঢোকার মুখে রেলকর্মীদের কোয়ার্টার্স, যেমন দেখা যায়। শুধু দেখা নেই রেললাইনের। ফলে, কোনও ট্রেন আজ পর্যন্ত এসে পৌঁছয়নি এই স্টেশনে!

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৬ ১৯:৫৫
রেললাইনহীন নন্দীগ্রাম স্টেশন।—নিজস্ব চিত্র।

রেললাইনহীন নন্দীগ্রাম স্টেশন।—নিজস্ব চিত্র।

গোধূলির আলো এসে পড়েছে স্টেশনে।

লালচে লাগছে প্ল্যাটফর্ম দুটোকে, যেমন লাগে। রয়েছে লোকজনের আনাগোনা, যেমন হয়। দু’পাশ জুড়েছে একটা ওভারব্রিজ, যেমন জোড়ে। আছে একটা টিকিট কাউন্টার, যেমন থাকে। রয়েছে স্টেশনে ঢোকার মুখে রেলকর্মীদের কোয়ার্টার্স, যেমন দেখা যায়। শুধু দেখা নেই রেললাইনের। ফলে, কোনও ট্রেন আজ পর্যন্ত এসে পৌঁছয়নি এই স্টেশনে!

গোধূলি আলোয় দেখা এই স্টেশনের নাম? নন্দীগ্রাম।

প্রায় ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত গোটা জনপদের আনাচ-কানাচ ঘুরেও যে কথাটা স্পষ্ট ভাবে শোনা যায়নি কারও মুখে, সেই না-বলা কথাটাই জনপদের মুখপত্র হিসাবে জানিয়ে দিল বেলাশেষের রেলস্টেশন— উন্নয়নের কোনও ট্রেনই আসলে এসে পৌঁছয়নি নন্দীগ্রামে।

ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন শক্তিপদ মণ্ডল। নন্দীগ্রাম-১ ব্লক অফিসের সামনে। তখন বেলা সাড়ে ১০টা হবে! রোদ্দুরের ঝাঁঝে ভাল করে তাকানো যাচ্ছিল না। একটা ভ্যানরিকশায় বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। প্রশ্ন করা গেল, ‘‘কেমন কাটালেন গত পাঁচ বছর?’’ জবাব এল একটু পর। তত ক্ষণে একটা বিড়ি ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা পুকুরের জলে জোরসে ছুড়ে দিয়েছেন— ‘‘ভাল। বেশ ভাল কাটালাম।’’ কী করেন? ‘‘জাল বুনি।’’ উন্নয়নের কাজ ভালই হয়েছে তবে? বৃদ্ধ তেরচা চোখে তাকিয়ে তৃপ্তির বিড়ি টানায় ব্যস্ত। আবারও একই প্রশ্ন ছোড়া গেল। জবাব এল, ‘‘শুনছি তো তাই।’’ শুনছেন! দেখছেন না? ‘‘আমি আর বাড়ি থেকে বেরোই কই? তবে, রাস্তাঘাট হয়েছে, আলো এসেছে।’’ তার পর? অসম্ভব নীরব হয়ে গেলেন শক্তিপদবাবু। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে মুখ ঘুরিয়ে বিড়ি টেনেছেন। শেষ প্রশ্নটা এ বার করতেই হল, ‘‘আপনি কি কথা বলতে চাইছেন না?’’ এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে অপ্রত্যাশিত জবাবটা এল, ‘‘না।’’ তার পরে সেই পুকুরেই পোড়া বিড়ির শেষাংশটা ছুড়ে দিলেন তিনি। যার ও পারে কালচে লাল রঙের নন্দীগ্রাম থানা।

দেখুন নন্দীগ্রামের ভিডিও

নন্দীগ্রামের আনাচ-কানাচ ঘুরতে ঘুরতে এটাই টের পাওয়া যাচ্ছিল। আসলে জমি আন্দোলনের সাফল্য নন্দীগ্রামের মানুষকে করে তুলেছিল আরও প্রত্যয়ী। কেমিক্যাল হাব নয়, উন্নয়নের বিকল্প ধারাকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। সেই প্রত্যয়ে অক্সিজেন জুগিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। সরকারে আসার আগে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি, সব দিক থেকে নন্দীগ্রামকে রাজ্যের মানচিত্রে উপযুক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করার বিভিন্ন আশাও জাগানো হয়। শহিদ পরিবারগুলিকে এককালীন অর্থ, চাকরির ব্যবস্থা, বিপিএল-সহ একাধিক তালিকায় নাম তুলে দেওয়া যার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল। তার পরে রাস্তা, আলোও এসেছে। ছিল কাঠামো তৈরির নানা উদ্যোগ— স্টেশন থেকে হাসপাতাল, আইটিআই থেকে কিষানমান্ডি, আরও কত কী। ব্যস! এর পরেই হঠাত্ করে সব চুপসে গেল কেন? রং তো অনেক দূরের শব্দ, কাঠামো গড়ার পরেও খড়ের গায়ে আর মাটির প্রলেপ দেওয়া গেল না! যদিও নিজের অফিসে বসে বিষয়টা মানতে চাইলেন না ব্লক সভাপতি আবু তাহের। জমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন সেই সময়ে। রাজ্যের মধ্যে এখন বিভিন্ন বিষয়ে এক নম্বর এই ব্লকের সভাপতির মুখে উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি নামতার মতো ফুটে ওঠে। এক এক্কে এক— হাসপাতাল, দুই এক্কে দুই— কর্মসংস্থান, তিন এক্কে তিন— কিষানমান্ডি...গোটাটাই উন্নয়নের ধারাপাত।

কিন্তু, নন্দীগ্রামের মানুষ রাস্তা, আলোর পর আর এগোতে পারছেন না কেন? কেন চুপ করে থাকছেন? কথা বলতে চাইছেন না কেন? তবে কোন উন্নয়নের মুখ দেখল নন্দীগ্রাম?

২০০৭-এর ৭ জানুয়ারি মাঝরাতে খেজুরির দিক থেকে ছুটে আসা একটি বুলেট ঢুকে গিয়েছিল ভাঙাবেড়া ব্রিজের এ পারে থাকা ভরত মণ্ডলের পেটে। নন্দীগ্রাম ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে যেতেই প্রাণ গিয়েছিল। জমি আন্দোলনের প্রথম শহিদের মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছর কেমন কাটাল তাঁর পরিবার? শহিদের বাবা ধনঞ্জয়বাবুর কথায়, ‘‘আমরা ভাল আছি।’’ সরকারকে নিশ্চয়ই আপনাদের পাশে পেয়েছেন? জবাব এল, ‘‘আমরা সরকার থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছি। তবে, যে সরকার মেরেছিল তাদের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। পরে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা দিয়েছে।’’ কী দিয়েছে? ‘‘তিন লাখ টাকা।’’ আর? ‘‘ভরতের স্ত্রীকে একটা ছোটখাটো চাকরি।’’ সেই টাকা ইতিমধ্যেই মাথা গোঁজার ঠাঁইকে ঠিকঠাক করতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। তার পর? উন্নয়নের চাকা আর এগোয়নি। পরিবারে তো বটেই, জনপদেও।

ওই বছরেরই ১৪ মার্চ ভাঙাবেড়া সেতুর কাছেই গুলিতে মাথা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল সুপ্রিয়া জানার। সোনাচূড়া বাজারে বসে তাঁর স্বামী সুকুমার জানা বললেন, ‘‘সরকারি হিসেবে মোটামুটি কাজকর্ম খুব ভাল হয়েছে।’’ মোটামুটি কেন বলছেন? তাঁর কথায়, ‘‘আসলে মানুষের চাহিদার তো শেষ নেই!’’

আরও পড়তে ক্লিক করুন
সেই ইলিয়াস আর নেই, সেই নন্দীগ্রাম আছে তো?

আসলে নন্দীগ্রামের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এক জনই। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামের মানুষের কথায়, তাঁরা শুধু জমিটাই বাঁচাতে চেয়েছিলেন। বাকি চাহিদার খিদে ধীরে ধীরে বাড়িয়েছেন তিনিই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে, পরেও। গোকুলনগরের মাঠে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলেছিলেন, ‘‘নন্দীগ্রামে কৃষিবিপ্লব হবে, শিল্পবিপ্লব হবে। রেলের কারখানা হবে। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হবে।’’ সেই কথায় নন্দীগ্রাম ভেসেছে। বেড়েছে চাহিদাও। কিন্তু, প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। হাসপাতালের বাড়ি এখনও নির্মীয়মান। কিষানমান্ডি তৈরি হলেও, চাষিদের আনাগোনা নেই প্রায়। সোনাচূড়া বাজারের কাছে রেলের যন্ত্রাংশ তৈরির প্রজেক্ট তালপাটির জলে মিলিয়ে গিয়েছে। নন্দীগ্রামের মানুষ উন্নয়ন নিয়ে বাড়তি একটা কথাও বলতে চাইছেন না। অথচ চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কিছু যেন বলার আছে। কারণটা খোলসা করে না বললেও আমতা আমতা ভাবে দু’টি শব্দ উচ্চারণ করলেন নন্দীগ্রামের সিপিআই প্রার্থী কবীর মহম্মদ, ‘‘ওদের ভয়ে!’’ ব্যস। আর কিছু বলতে চাইলেন না তিনি।

এমন একটা পরিস্থিতিতে তাঁদের মুখপত্র হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রাম স্টেশন। গোধূলির আলো গায়ে মেখে যে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেয়, নানা রকমের ঢক্কানিনাদের মধ্যে নন্দীগ্রামের দেহে আসলে প্রাণের সঞ্চারটাই করানো যায়নি।

Nandigram
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy