স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরেও আমানিগঞ্জ আছে আমানিগঞ্জেই।
এক প্রান্তে নবাবি আমলের সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ পুরসভা। অন্য প্রান্তে ব্রিটিশ ভারতের কিছু দিনের রাজধানী বহরমপুর শহর। আলো ঝলমলে দু’পাশে দু’টি পৃথক ‘ইন্ডিয়া’র সীমানা ছুঁয়ে মাঝখানে অন্ধকারে ডুবে আছে এক ‘ভারত’— আমানিগঞ্জ চর। ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া প্রান্তবাসী সেই ভোজপুরিদের গ্রাম আমানিগঞ্জ চরের একটি প্রান্ত ছুঁয়ে আছে বহরমপুর শহরের উত্তরপ্রান্তের ফরাসডাঙা। অন্য প্রান্ত মিশেছে ঐতিহাসিক শহর মুর্শিদাবাদ (লালবাগ)-এর সীমানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরে নতুনগ্রাম পঞ্চায়েতের চিনাজলপাড়ায়।
আমানিগঞ্জ চর বাঁ হাতে রেখে ফরাসডাঙা হয়ে ঝাঁ চকচকে রাজপথ মিশেছে লালবাগের মোতিঝিলে। প্রায় সাড়ে ছয় দশক বয়সের গণতন্ত্রে আমানিগঞ্জ চরের প্রাপ্তি কেবল মোরাম বিছানো আড়াই কিলোমিটার রাস্তা। এক দশক আগের সেই রাস্তার দশা এখন লোম ওঠা মুমূর্ষু পথকুকুরের মতো। গণতন্ত্র আর কিছু দেয়নি শুনেই আমানিগঞ্জ রে রে করে তেড়ে ওঠে। বলে, ‘‘না বাবু! গণতন্ত্রবাবুকে তো দেখিনি কখনও! গণতন্ত্রবাবু এ গাঁয়ে পা দেয়নি কোনও দিন।’’ মনে পড়ে যায় নকশাল আমলে লেখা মণি মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘গণতন্ত্র ও গোপাল কাহার’ গল্পের কথা।
‘গণতন্ত্র হত্যা’র অপরাধে ধৃত গল্পের নায়ক হতদরিদ্র গোপাল কাহার পুলিশের আড়ং ধোলাই খেয়ে জানিয়েছিল, ‘‘গণতন্ত্রবাবুকে আমি চিনি না হুজুর!’’ কয়েক দশক আগে তেরঙ্গা আমলের গল্পের গোপাল কাহারের ‘গণতন্ত্র দর্শন’ ৩৪ বছরের লাল জমানা কাটিয়ে আধ দশকের নীলপাড় সাদা-জমিনের দিদির আমল শেষেও একই রয়ে গিয়েছে আমনিগঞ্জের ভোজপুরি গোপালকদের কাছে। লাল আমলের সংস্কারহীন লাল সড়কের লালধুলোয় জোড়া ফুলের শাসনের গ্রীষ্মে জেরবার আমানিগঞ্জ। বর্ষায় উঠোনময় লালকাদা। প্রাপ্তি আরও আছে। বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে, কিন্তু পথবাতির হদিশ নেই। গোপালকের গ্রাম আমানিগঞ্জের আঁধারই ভবিতব্য।
বহরমপুর ও লালবাগের সঙ্গে আমানিগঞ্জের যোগাযোগের একমাত্র পথ।
সাক্ষরতার হার তলনিতে। অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। বার্ধক্যভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ন-মাসে, ছ-মাসে জোটে বটে। তবে তার একটি অংশ জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের হকের পাওনা বলে কেটে নেন। হাজার চারেকের জনবসতিতে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও গ্রামের প্রান্তে একটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র। গ্রামের মধ্যে হলে গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্যকর্মীদের আবার হাঁটতে হত! বরং রোগীরাই হাঁটুক। অধিকাংশই কুড়েঘর। তবে রয়েছে বজরঙ্গবলীর দু’টি সুদৃশ্য পাকাদালানের মন্দির। ভোটের বাজনা না বাজলে সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বা পঞ্চায়েত প্রধান— কারও পা পড়ে না গ্রামে। আমানিগঞ্জের বারোমাস্যার সংসারে বজরঙ্গবলীই তাঁদের ভরসা।
চিনাজলপাড়া থেকে আমানিগঞ্জে ঢোকার মুখে লালসড়কের দু’ পাশে দু’টি পুকুর রয়েছে। পুকুর পাড়ের ভাঙনে নেতাদের গাড়ি গ্রামে যাবে কি না সংশয় রয়েছে। ভোটের পর পুকুর পাড় বাঁধিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অবশ্য ছড়ানো হবে। এক যুগ আগে বলা হয়েছিল, ২০১০ সালে পিচ-পাথরে রাস্তা মুড়িয়ে দেওয়া হবে। যথারীতি হয়নি। একদা মোরাম বিছানো উটের পিঠের মতো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বিপজ্জনক ভাবে সাইকেলের হ্যান্ডেলে দুধবোঝাই হাঁড়ি নিয়ে টাল খেতে খেতে সকাল-সন্ধ্যা আমানিগঞ্জ পৌঁছে যায় বহরমপুর ও লালবাগ শহরের বাবুদের বাড়ি। শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রাণ রক্ষা হয়। দুধ-কফিতে চুমুক দিয়ে কল্যাণকামী গণতন্ত্রের জন্য আমরা ‘ইন্ডিয়া’র নাগরিকরা টেবিল চাপড়াই। আমানিগঞ্জের গোলাপ কাহাররা তবুও ভারতের ‘গণতন্ত্রবাবু’-কে চিনতেই পারেন না! তবু ভোট দেন।
ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy