আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার সঙ্গে কাইজার আহমেদ। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
এসি গাড়ি থেকে নামা মাত্রই সক্রিয় তিন-তিনখানা হাতপাখা। তেঁতুলগাছের ছায়ায় বসিয়ে প্রাণপণে হাওয়া দিয়েও তাঁর চাঁদি ঠান্ডা করা যাচ্ছে না!
ফোন কানে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা খিঁচিয়ে উঠছেন, ‘‘কই তোদের ভগবানপুরের হোমরা-চোমরা নেতারা সব কোথায়! যে যেমন পারছে মাথা ফাটাচ্ছে। লিডাররা কি পোঁ* তুলে পালাল?’’ মুখে নাগাড়ে ছুটছে কুকথার ফোয়ারা।
ভাঙড় বিধানসভার ভগবানপুর অঞ্চল। ওই তল্লাটে নারকেলবেড়িয়ায় তার কয়েক মুহূর্ত আগেই অ্যাম্বুল্যান্সে সওয়ার দুই মাথা-ফাটা দলীয় কর্মীকে দেখেছেন। শনিবার, বেলা ১১টা। শাসক দলের প্রার্থী দাঁড়িয়ে শুনলেন, দলে তাঁরই নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান আরাবুল ইসলামের অনুগতরাই ‘মেশিন’-এর বাঁট দিয়ে দু’জনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। একটু এগিয়ে সাতুলিয়ায় পৌঁছতেও একই করুণ ছবি। অভিযোগ, পূর্ব সাতুলিয়ায় ৬৪ ও ৬৫ নম্বর বুথ থেকে সিপিএম প্রার্থী রশিদ গাজি বেরোতেই ‘র্যাফ’ পেটাতে শুরু করেছে। রেজ্জাকের
এজেন্ট ফকিরুল আলি মোল্লার চশমা ভেঙেছে।
৩৪ বছর শাসক বামফ্রন্টের ডাকসাইটে মন্ত্রী, টানা ন’দফায় বিধানসভার সদস্য, অধুনা তৃণমূল প্রার্থী রেজ্জাকসাহেব তার পরই জনৈক সহযোগীকে ফোনে ধরে দিতে বললেন। চলল বিস্ফোরণ! ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’ আরাবুল ইসলামের সঙ্গে রেজ্জাকের ‘মধুর সম্পর্ক’ ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত। তাঁর বিধানসভা-যাত্রা ঠেকাতে আরাবুল যে ‘কেরামতি’ চালু করে দিয়েছেন, তা স্বয়ং রেজ্জাকই চাউর করে দিয়েছেন। কিন্তু ভোটের দিনের টাটকা ‘অপমানে’র স্বাদটা সম্ভবত একটু বেশিই তেতো লাগল। যার বহিঃপ্রকাশ, সেই ফোনের কথোপকথন।
ভোট অবশ্যই কম দেখেননি তিনি। সেই ’৭২ সালে জ্যোতি বসুর হারের বছরেও ভাঙড়ে তখনকার তরুণ নেতা রেজ্জাকের জয় ঠেকানো যায়নি। সে-বার সাইকেলে করে গোটা কেন্দ্র ঘুরেছিলেন তিনি। ঈষৎ ঠান্ডা হওয়ার পরে গলার ট্রেডমার্ক গামছাটায় এক বার টান মেরে রেজ্জাক এ দিন নিজেই বলছিলেন, ‘‘৮২ সালের পরে ভোট-বৈতরণী পার হতে আমায় কখনও কন্ট্রোল রুমের বাইরে যেতে হয়নি। সেখানে বসেই এলাকা কন্ট্রোল করতাম।’’ তিন দশক পরে এ বার ফের পথে নামা। সাইকেলের বদলে অবশ্য কালো এসইউভি রয়েছে। তবু কোথাও যেন বাজছে বিষয়টা। গত ৩৪ বছরের মতো এ বারও তো তিনি শাসক দলেরই প্রার্থী। তবু কেন এত পরিশ্রম? কোথায় গেল দলের সংগঠন? শুনে, রেজ্জাকসাহেবের মেজাজ ফের সপ্তমে। ‘‘নির্বাচনের চেয়ারম্যান (আরাবুল) চেয়ারেই থাকুক!। আমার কাউকে লাগে না। একাই এনাফ!’’
এই বলাটায় সত্যির জোর নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ, সাতুলিয়ায় ভিড়-করা জনতার উদ্দেশে রেজ্জাকসাহেব বলেন, ‘‘আমি থাকতে-থাকতে ভোটটা দিয়ে দিন! পরে কী হবে বলতে পারব না।’’ একটু বাদে ঘটকপুকুরে দলীয় অফিসে তাঁর পাশে বসেই জেলা পরিষদের সদস্য কাইজার আহমেদের আশ্বাস, ‘‘চাচা (রেজ্জাক) ভাঙড়ে আমাদের অতিথি। ওঁকে জেতানো তো আমাদের দায়িত্ব।’’ এই ভাঙড়েই ৪৫ বছর আগের বিধায়ক রেজ্জাক। অলি-গলি চেনেন বলে দাবি করে থাকেন। তবু ‘অতিথি’ তকমাটায় মৃদু প্রতিবাদও করলেন না। সকাল থেকে পোলেরহাট, ভগবানপুর, ভোগালির ‘বিপজ্জনক’ বুথে ঘুরে হা-ক্লান্ত বৃদ্ধ প্রার্থী তখন এসি-ঘরে ঝিমোচ্ছেন।
ভাঙড়ের অফিসে আরাবুল। —নিজস্ব চিত্র।
ভাঙড়ের ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোটে কিছু বিক্ষিপ্ত ‘সেমসাইড’ ছাড়া শাসক দলের সাঙ্কেতিক ‘গুড় বাতাসা’র দাওয়াই এ দিন সে-ভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। তবে প্রবীণ নেতা রেজ্জাক দিনভর শশা-মুড়ি-বাতাসাযোগেই ‘জ্বালানি’ ভরে নেন। ঘটকপুকুরে পার্টি অফিসের মুরগি-ভাতের মেনু ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু দলের সহযোগীদের শত ভরসাতেও সন্ধে পর্যন্ত বুথ-সফরে ফাঁকির ঝুঁকি নিলেন না। দুপুরে ঘটকপুকুরের অফিসে খানিক ক্ষণ বসার পরে ক্যানিং (পূর্ব) কেন্দ্রের বাঁকড়িতে নিজের পারিবারিক ভিটেয় গিয়ে নিজের ভোটটা দিয়ে আসেন রেজ্জাকসাহেব। এর পরে ফের সাঁইহাটি, জামুলগাছি, পাঁড়জুল, চণ্ডীপুর জুড়ে ঘোরাঘুরি।
দিনভর অটুট অবশ্য ‘মুখে মারিতং জগত’ মেজাজটা। রেজ্জাকের দিনের বাণী— ‘জিতব না তো কি ঘোড়ার ঘাস কাটব?’, ‘হারতে নয়, ফসল তুলতে এসেছি’, ‘লোকে বলছে, সামনে পাহাড়, আমি দেখছি আল’, ইত্যাদি। তবে আরাবুলকে সরাসরি আক্রমণ এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু বলেছেন, ‘‘ও আবার ফ্যাক্টর না কী! ট্র্যাক্টর!’’ কিন্তু ট্র্যাক্টর তো জমি চাষ করে? রেজ্জাকসাহেবের ঝটিতি জবাব, ‘‘আমি তো চাষার ব্যাটা! আমারই জমি!’’
আরাবুলের এই ‘জমি চাষ’-করা রুখতেই রেজ্জাক-সঙ্গী নানু গাজী, ওহিদুল মণ্ডলেরা পোলেরহাট, চালতাবেড়িয়ায় দৌড়ঝাঁপ করেছেন বলে তৃণমূলের ভিতরের খবর। চালতাবেড়িয়ায় সিপিএম প্রার্থী রশিদ গাজি কিছু সন্ত্রাসেরও অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আরাবুলকে সত্যিই প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তবে আরাবুলের খাসতালুক উত্তর গাজিপুরে রেজ্জাক ভোটে ‘জল মেশাতে’ বলেছেন বলে অভিযোগ তুলে কয়েক জন তৃণমূল কর্মী ‘আরাবুল জিন্দাবাদ’, ‘রেজ্জাক মুর্দাবাদ’ স্লোগান তোলেন। শোনা যায়, রেজ্জাকসাহেব বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই দলনেত্রীর কানে তুলে দেন। এর পরেই গুটিয়ে যান আরাবুল।
ভোজেরহাটের কাছে একটি নির্মাণকাজের সাইটে এক বারই তাঁর দর্শন মিলেছে। মিডিয়ায় তাড়নায় একটু রাগলেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন আরাবুল। বলেছেন, ‘‘আমি কিছু বলব না! প্রার্থীর কথা শুনুন। রেজ্জাকসাহেবের জেতার ভাল সম্ভাবনা রয়েছে।’’ দলের অন্য সহযোগীরাও রেজ্জাকসাহেবকে সমানে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন। তবু দিনের শেষে প্রবীণ নেতার ফুরফুরে হাসিটা কিন্তু ঠোঁটের কোণে দেখতে পাওয়া গেল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy