Advertisement
১৯ মে ২০২৪

আর সইছে না যাতনা, কবে যে আসবে ১৯

ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে। মধ্যরাতে কালীঘাটের গর্ভগৃহে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে এ বারের এক হেভিওয়েট প্রার্থী। ব্যাপারটা নিছক দেবীদর্শন নয়। একটু নিরালা বেছে নিয়ে আসলে জমা পড়ছে অনুচ্চারিত প্রার্থনা। পার করে দিতে হবে ১৯ তারিখটা!

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০৩:৫৫
Share: Save:

ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে। মধ্যরাতে কালীঘাটের গর্ভগৃহে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে এ বারের এক হেভিওয়েট প্রার্থী। ব্যাপারটা নিছক দেবীদর্শন নয়। একটু নিরালা বেছে নিয়ে আসলে জমা পড়ছে অনুচ্চারিত প্রার্থনা। পার করে দিতে হবে ১৯ তারিখটা!

দেবস্থানই সকলের একমাত্র গন্তব্য হতে হবে, তা তো হতে পারে না! কমিউনিস্ট পার্টি করলে প্রকাশ্যে সে সব করা আরও অসম্ভব। কিন্তু টেনশন যাবে কোথায়? জাঁদরেল এক জেলা সম্পাদক চলে গিয়েছেন দার্জিলিং। পাহাড়ি হাওয়ায় ক’টা দিন যদি ভোটের হাওয়ার আঁচ থেকে একটু দূরে থাকা যায়! তাঁরই সতীর্থ এক সাংসদ লোকসভার অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও রয়ে গিয়েছেন দিল্লিতে। কলকাতায় থাকলেই বেশি বেশি করে লোকে ধরবে, কী হবে বলুন তো? তার চেয়ে দিল্লিতে অন্তত কৌতূহল একটু কম!

মন্দিরে ফুল দিয়ে, দরগায় দোয়া চেয়েও মন শান্ত হচ্ছে না এক প্রার্থীর। তাঁর ভোট হয়ে গিয়েছে সেই ৪ এপ্রিল! এখন ভাবলে সুদূর অতীতের কথা! যত দিন অন্যান্য জায়গায় ভোট চলছিল, তা-ও এক রকম। এখন সব মিটে যাওয়ার পরে তাঁর মাথায় চিন্তা ঢুকেছে, কলেজের স্ট্রংরুমে উপর তলার ঘরে রাখা ভোটযন্ত্রে সব ঠিক থাকবে তো? রাঢ়বঙ্গে যা গরম, ভোটযন্ত্রের ব্যাটারি যদি গলে যায়! নির্বাচন কমিশন অবশ্য জানিয়েছে, এ রকম কোনও সম্ভাবনা নেই। ভোটযন্ত্রের সুরক্ষার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া আছে।

বহু ভোট পার করে-আসা কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান প্রার্থী ভোট-চিন্তা থেকে মনকে একটু মুক্তি দেবেন বলে পাড়ি দিয়েছিলেন তারাপীঠ। যেখানেই থামেন, পুলিশ এসে ধরে! ভক্তি গদগদ ভাব! কোনও চিন্তা নেই স্যর। আমাদের একটু দেখবেন! প্রার্থী আরও চিন্তা নিয়ে ফেরত এসেছেন।


চাপ কমাতে। রাসবিহারী কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়।
পানিহাটির কংগ্রেস প্রার্থী সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবানীপুরের বিজেপি প্রার্থী চন্দ্র বসু। ছবি : স্বাতী চক্রবর্তী ও সজল চট্টোপাধ্যায়

শাসক দলের এক বিধায়ক যে কোনও ঘরোয়া আ়ড্ডাতেও উৎকণ্ঠার ছিটেফোঁটা ফেলতে দিচ্ছেন না! অসম সাহসে চালিয়ে খেলছেন এই বলে যে, তৃণমূলের সরকারের ফিরে আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বিধানসভার কমিটিগুলির বিদায়ী বৈঠকে বাকি আলোচনা নমো নমো করে সেরে যখন ভোটের ফলের কথাই জুড়ে বসছে, আক্রমণাত্মক অবস্থান বজায় রাখছেন। কিন্তু বিধানসভার লবিতে পরিচিত মুখ পেলে একান্তে জানতে চাইছেন, লোকে এত লাইন দিয়ে কোন দিকে মেরে এসেছে বলুন তো? কিছু তো বোঝা যাচ্ছে না! সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনা আরও এক টুকরো সংলাপ— ‘‘এর চেয়ে ৪২-৪৩ ডিগ্রিতে ভোটের প্রচার ভাল ছিল! ঠান্ডা ঘরে বসে এই কী হবে, কী হবে আর সওয়া যাচ্ছে না!’’

সইছে না আসলে কারওরই! কোনও শিবিরে কেউ শান্তিতে নেই। প্রতীক্ষা বলে প্রতীক্ষা! শেষ ভোটের দিন আর ফলপ্রকাশের মধ্যে ঝাড়া দু’সপ্তাহের ফারাক! ভোটে এমন দীর্ঘ প্রতীক্ষা বাংলা আগে দেখেনি। উদ্বেগে, আশঙ্কায় চুল ছিড়ে ফেলার জোগাড়! যাঁর ভোট যত আগে হয়েছে, তাঁর অপেক্ষা তত লম্বা। প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা একটু নেতা-স্থানীয়, নিজের ভোটের পরে অন্যত্র প্রচারে সময় দিয়েছেন। বাকিদের শুধু দিন গোনা আর জল্পনা! বাম শিবিরে তা-ও বরাবরের কিছু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আছে। নেতা বা প্রার্থীরা তাতে গা ভাসিয়ে রাখতে পেরেছেন। আর অন্য দিকে তৃণমূল, বিজেপি বা কংগ্রেস প্রার্থীরা কোনও মন্দির-দরগা বাদ দেননি! শাসক দলের এক প্রার্থীর কথায়, ‘‘স্কুল ফাইনাল দেওয়ার পরে রেজাল্টের জন্য বসেছিলাম অনেক দিন। কেমন পরীক্ষা দিয়েছি, নিজে জানতাম। কিন্তু এখানে তো আমার পরীক্ষা আমার হাতে নেই!’’

যুযুধান সব শিবিরের সেনাপতিদের জন্যও সময়টা বিচিত্র এবং ফাঁকা ফাঁকা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এই সময়টায় এক দিন সওয়া ঘণ্টা বাদ দিলে আর নবান্নমুখো হননি। নিজেই নিজের নেটওয়ার্কে হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কালীঘাটে বিশেষ কাউকে আমলও দেননি। পুরীর আশীর্বাদ, তৃণমূল ভবন থেকে গণেশ বন্দনার প্রসাদ, জ্যোতিষীর বচন— এগুলো অবশ্য নিয়ম মেনেই এসেছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন আলিমুদ্দিনের কেজো রুটিনে। জেলা থেকে হিসেব পেয়েছেন। কিন্তু তাতে ভেসে যাননি। নিজের হিসেব নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন! আর দলে ঠিক হওয়া নীতি হিসেবে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস মোকাবিলার বার্তা শুধু নিয়ম করে দিয়ে চলেছেন। প্রচারের ধকল শেষে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বরং কিছু দিন সময় পেয়েছেন লোকসভার অধিবেশনে নজর ঘুরিয়ে রাখার। ফলপ্রকাশের আগে শেষ ক’টা দিনে অবশ্য সেই অবসরও নেই! দলে ঘনিষ্ঠ মহলে যদিও আত্মবিশ্বাসীই শুনিয়েছে প্রদেশ সভাপতির গলা, জোট-সরকার হয়েই যাবে মনে হচ্ছে!

হক কথাটা বলে ফেলেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। ‘‘কোথায় কী স্যুইং হয়েছে, কেউ বলতে পারছে? সব বোঝা যাবে ১৯ তারিখ!’’ অকপটে বলেছেন ৭৬ বছরের পক্ককেশ। তত দিন? অসহ্য যাতনা সয়ে দিন গুনে যাওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করা? অসহায় ভঙ্গিতেই এক জোট-প্রার্থীর স্বীকোরোক্তি, ‘‘একই লোককে রোজ রোজ ফোন করে একই কথা জিজ্ঞাসা করছি। কী হবে ১৯শে? কথা বললে যদি একটু টেনশন কমে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 candidate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE