Advertisement
E-Paper

শাসকের শাসানিকে টক্কর কেন্দ্রীয় বাহিনীর

বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের অনেক তৃণমূল-বিরোধী ভোটারকে গত দু’দিন ধরে শুনতে হয়েছে এই দু’টি বাক্য। আতঙ্কের ওই আবহ বহু ভোটারকেই বাড়িতে আটকে রেখেছিল।

অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয় তরফদার

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৭
বুথের সামনে হাতেনাতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বুথের সামনে হাতেনাতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

‘ভোট দিতে যাবেন না। কথা না শুনলে কিন্তু বিপদ আছে।’

বেলেঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের অনেক তৃণমূল-বিরোধী ভোটারকে গত দু’দিন ধরে শুনতে হয়েছে এই দু’টি বাক্য। আতঙ্কের ওই আবহ বহু ভোটারকেই বাড়িতে আটকে রেখেছিল। স্বভাবতই, দিনের শেষে ভোটের হার কম। এর মধ্যেও যাঁরা ভয়কে জয় করে ইভিএমের সামনে পৌঁছেছেন, তাঁদেরকে ভরসা জুগিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া প্রহরা। নির্বাচন কমিশনের চাপে পড়ে কী কেন্দ্রীয় বাহিনী, কী কলকাতা পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে তৃণমূলের একাধিক কর্মী-সমর্থককে। বহু বুথের আশপাশে তৃণমূলের লোকজনদের ঘেঁষতে দেননি তাঁরা। যা দেখে ভোটের দায়িত্বে থাকা তৃণমূলের নেতাদের তিলজলায় তৃণমূল ভবনে ফোন করে বলতে হয়, ‘‘শাসক দলের কর্মী সমর্থকদের এত মারলে ভোট হবে কী করে। পুলিশকে থামান।’’

সকাল ৯টাও বাজেনি। রাসমণি বাজারের বারোয়ারি তলায় একটি গলির মুখে একা দাঁড়িয়েছিলেন বছর পঁচিশের এক তরুণী। হাতে ক্যামেরা, বুকে নির্বাচন কমিশনের কার্ড দেখেই হয়তো ইশারায় গলির ভিতরে যেতে বললেন। সেখানে যেতেই বললেন, ‘‘বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছে না। ভয় দেখাচ্ছে। বলছে ভোট দিতে হবে না। দেখুন না, ওদের শাসানির কারণে উল্টো দিকে শান্তিসঙ্ঘ বিদ্যায়তন বালিকা বিদ্যালয়ের বুথ ফাঁকা।’’ বাস্তবিকই দেখা গেল, সেখানে কেউ নেই।

ভয় দেখাচ্ছে কারা?

তরুণীর জবাব— তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা।

কোথায় তারা?

ফের ইশারা। বোঝালেন পাশেই কল্যাণ সমিতির গলিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। কথা মতো সেখানে গিয়ে দেখা মিলল জনা কয়েক যুবক-যুবতীর। এক জন ক্যামেরা দেখে চট করে সরে পড়লেন। সেখানেও এক মহিলা ব্যাপারটা লঘু করার জন্য আগ বাড়িয়ে বলতে থাকলেন, ‘‘দাদা, খুব শান্তিতে ভোট হচ্ছে। একটু লিখে দেবেন। দেখছেন না বুথ ফাঁকা।’’ তাঁর কথা শেষ না হতেই বুথের সামনে থাকা ইনস্যাসধারী এক জওয়ান এসে ওই মহিলাকে বললেন, ‘‘ফির ইধার আয়ি? জলদি অন্দর যাও, নেহি তো অন্দর কর দুঙ্গে।’’ এ বার সত্যিই ভয় পেলেন ওই মহিলা। জওয়ানও প্রায় তেড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন তাঁকে।

উপরের এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন, তেমন নয়। এই এলাকায় ৫০-এরও বেশি বুথের বেশ কিছু ভোটারদের থেকে ক্রমাগত এমন অভিযোগ এসেছে। মঙ্গলবার থেকেই এই অভিযোগ নিয়ে আশঙ্কার কথা পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের কথায়, গত পুরভোটে ছাপ্পা ভোট দিয়ে দলকে জিতিয়েছিল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া প্রহরায় সেই পথ ছেড়ে তারা ভোটারদের ভয় দেখানোর পথে নেমেছে। দু’দিন ধরে তৃণমূল-বিরোধী ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে, ‘ভোট দিতে যাবেন না।’

রাসমণি বাজারের আর একটি বুথের লাইনেও ভোটারদের হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছিল তৃণমূল সমর্থকেরা। আচমকা পৌঁছন ডিসি (ইএসডি)-র নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ও কলকাতা পুলিশের একদল জওয়ান। এক জনের কলার ধরে বুথের সামনে থেকে সরিয়ে দেন স্বয়ং ডেপুটি কমিশনার ধ্রুবজ্যোতি দে।

বেলেঘাটা মেন রোডের পাশে মিঞাবাগান, নবাববাগান, খালপাড়ে চাউলপট্টি রোড, ১, ২, ৩ এবং ৪ নম্বর বস্তি-সহ রাসমণি বাজার থেকে শুরু করে জোড়ামন্দিরের বহু এলাকায় ঘরে ঘরে শোনা গিয়েছে তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ। মূলত ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডেই এই খবর মিলেছে। বুথের মুখে গলিতে দাঁড়িয়ে থেকে তৃণমূল সমর্থকেরা লক্ষ্য রেখেছে, বারণ করার পরেও কারা এসেছেন। যা আরও অস্বস্তিতে ফেলেছে শান্তিপ্রিয় ভোটারদের। এরই মধ্যে দেখা গেল, লি কলিন্স স্কুলের রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে আসছেন এক মহিলা ঝুমা ভাণ্ডারী। কেন কাঁদছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘‘এ বারও ভোট দিতে পারলাম না। বুথে যেতেই প্রিসাইডিং অফিসার বললেন আমার ভোট পড়ে গিয়েছে।’’

তা হলে কি ছাপ্পাও হচ্ছে?

সেল্স ট্যাক্স অফিসের ভিতরে ২৬৯ নম্বর বুথে সিপিএমের এজেন্ট ছিলেন রণদীপ রায়। ছাপ্পা ভোট রুখতে গিয়ে তাঁকে তৃণমূল কর্মীদের হাতে মার খেতে হয়েছে বলে কমিশনে অভিযোগ জানান প্রার্থী রাজীব বিশ্বাস। মুহূর্তে সেখানে চলে আসেন কলকাতা পুলিশ ও কেন্দ্রীয় জওয়ানেরা। তাঁদের সামনেই রণদীপের অভিযোগ, ‘‘১২ জন জাল ভোটার এসেছিল কোনও পরিচয়পত্র ছাড়াই। পাঁচ জনকে রুখেছি। বাকিদের পারিনি।’’ রণদীপ জানান, এর পরে নিজের ভোট দিতে তিনি পাশেই ২৭৩ নম্বর বুথে যান। ফেরার পথে তৃণমূলের ছেলেরা তাঁকে মারধর করে বলে অভিযোগ।

ভয় দেখানো এবং ছাপ্পার অভিযোগ রয়েছে বাইপাস সংলগ্ন বেলেঘাটাতেও। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘সিপিএমের এজেন্ট যাতে বুথে আসতে না পারে, তার জন্য বুধবার রাতেও চমকাতে তাঁদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ছিল তালাবন্ধ।’’ অথচ সকালে তাঁদেরকে বুথে দেখে রীতিমতো ক্ষিপ্ত ওই নেতা। বললেন, ‘‘এ বার চাল ফেল করল। রাতে বাড়ি ছাড়া থাকবে বুঝতে পারিনি।’’

কেন্দ্রীয় জওয়ানদের পাশাপাশি এ দিন কলকাতা পুলিশের অতি সক্রিয় আচরণও অস্বস্তিতে ফেলেছিল তৃণমূল কর্মীদের। বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল এবং সেরামিক ইনস্টিটিউশনের কাছে জড়ো হয়েছিল তৃণমূলের একদল কর্মী-সমর্থক। বেলেঘাটা মেন রোডের উপরে। এত লোক কেন রাস্তায়— এ খবর পেয়ে আচমকা পুলিশ ও জওয়ানদের সশস্ত্র দল তাড়া করে তাদের। প্রথমেই এক জনকে তুলে নেয় পুলিশ ভ্যানে।

স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার অভিযোগ, যাকে পুলিশ ধরেছে, তার বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। ভোটের ব্যাপারে সে ছিলই না। প্রতিবাদে অন্য সমর্থকেরা পথ অবরোধের হুমকি দেন। অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সেই ছবি তুলতে গেলে তাঁদের উপরে চড়াও হয় ওই তৃণমূল সমর্থকেরা। একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের চিত্রগ্রাহক অর্ক ভাদুড়ীকে মারধর করা হয়। ওই খবর পেয়ে ফের কলকাতা পুলিশের একটি দল অভিযান চালায় এলাকায়। তাড়া করে আর এক জনকে ধরে। শেষমেশ পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় তৃণমূলের জমায়েত। এ সব দেখে স্থানীয় এক কর্মী বলতে থাকেন, ‘‘পুলিশ এ ভাবে পেটালে কী ভাবে কাজ করব।’’ তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগে পুলিশ দিনের শেষে ৫২ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে ৩ জন মহিলা।

বেলেঘাটা বিধানসভায় সংখ্যালঘু এলাকা বলে পরিচিত ২৮, ২৯ এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট হয়েছে প্রায় নির্বিঘ্নেই। স্থানীয় তৃণমূল সূত্রের খবর, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ইকবাল আহমেদকে এ বার ভোটে কাজে লাগাননি দলীয় প্রার্থী। স্বভাবতই তিনি সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিলেন। কেউ কেউ মনে করছেন, ওই তিন ওয়ার্ডে দলীয় কোন্দল দলকে অস্বস্তিতে ফেলবে।

assembly election 2016 TMC CPM
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy