Advertisement
E-Paper

সিপিএমকে ভোট! ফের মার

বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর হল। চলল অবাধে লুঠপাটও। অথচ সেই আক্রান্তদেরই গ্রেফতার করল পুলিশ! পুলিশ সুপার বদলে গেলেও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারল না বীরভূম জেলা পুলিশ, এমনটাই দাবি করছে বিরোধীরা। পাড়ুইয়ের পরেই ভোট পরবর্তী হিংসায় উত্তপ্ত হল সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত দুবরাজপুরের পারুলিয়া পঞ্চায়েতের মাজিগ্রাম।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫৯
হামলার চিহ্ন। আতঙ্কিত সিপিএম কর্মী অসীম মালের পরিবার। ইনসেটে কান্নায় ভেঙেছেন চন্দনাদেবী। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

হামলার চিহ্ন। আতঙ্কিত সিপিএম কর্মী অসীম মালের পরিবার। ইনসেটে কান্নায় ভেঙেছেন চন্দনাদেবী। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর হল। চলল অবাধে লুঠপাটও। অথচ সেই আক্রান্তদেরই গ্রেফতার করল পুলিশ!

পুলিশ সুপার বদলে গেলেও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারল না বীরভূম জেলা পুলিশ, এমনটাই দাবি করছে বিরোধীরা। পাড়ুইয়ের পরেই ভোট পরবর্তী হিংসায় উত্তপ্ত হল সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত দুবরাজপুরের পারুলিয়া পঞ্চায়েতের মাজিগ্রাম। যেখানে তৃণমূলকে ভোট না দেওয়ার অপরাধে বাম কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুঠপাটের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের ঘটনায়। কিন্তু, সোমবার রাতের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ যে ছ’জনকে ধরেছে, তাঁদের চার জনই বাম কর্মী-সমর্থক। যার পরেই পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন জেলার বাম নেতৃত্ব। তৃণমূল যদিও গোটা ঘটনার দায় বামেদের ঘাড়েই চাপিয়েছে। এক দলীয় কর্মীর স্ত্রীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া ও লুঠপাটের পাল্টা অভিযোগও করেছে তৃণমল। দু’পক্ষই মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা পক্ষপাতের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া মেলেনি জেলার নতুন এসপি সব্যসাচীরমণ মিশ্রের। তিনি এ দিন ফোন ধরেননি, এসএমএস-এরও উত্তর দেননি।

সিপিএমের দাবি, সোমবারের ঘটনায় দলীয় কর্মী সুনীল মাজির বাড়ি থেকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা চারটি গরু চুরি করেছে, তাঁর ছেলের দোকানও ভাঙচুর করা হয়েছে। সেই সুনীলবাবুকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি ছাড়া বাকি ধৃতেরা হলেন মনচোরা বাউড়ি, ফটিক বাউড়ি, নীলকান্ত ধারা ও সুরেশ মণ্ডল। সুরেশবাবুকে দলীয় কর্মী বলে দাবি করেছে তৃণমূল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের অভিযোগ, ‘‘শাসকদল যেখানেই ইচ্ছেমতো ভোট করাতে পারেনি, সেখানেই প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে। মাজিগ্রামে আক্রমণের কারণ সেটাই।’’ তাঁর দাবি, স্থানীয় হাজরাপুর থেকে লোকজন জন নিয়ে এসে মাজিগ্রামে দলীয় কর্মী-সমর্থকদেরে বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূল। বাড়ি থেকে গরু-ছাগল খুলে নিয়ে চলে যায়, লুঠপাট ভাঙচুর চালায়। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘আমরা সাহায্য চাইলে গ্রামে গিয়ে আক্রান্তদেরই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের এই ভূমিকা নিন্দনীয়।’’

এ দিন সকালে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, প্রায় দেড় হাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট গ্রামটি কার্যত পুরুষ শূন্য। রাতে হামলা হলেও এলাকায় পুলিশের দেখা মিলল না। সুনীলবাবুর বাড়িতে ঢুকতেই নজরে এল একটি টিলের চাল ভেঙে পড়ে আছে। বাড়ির মধ্যে আতঙ্কিত পরিবারের মহিলারা। বড় পুত্রবধূ রূপালি মাজি ও ছোট পুত্রবধূ বর্ণালী মাজি বললেন, ‘‘রবিবার একটি নাবালক ছেলেকে ছাপ্পা ভোট দিতে পাঠিয়েছিল তৃণমূল। সেটাই ধরে ফেলেন সিপিমের লোকজন। এখান থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত। তার সঙ্গে কেন আমরা সিপিএমকে ভোট দিলাম, সেই রাগও যুক্ত হয়েছে।’’ তাঁরা জানান, এ নিয়ে স্থানীয় ক্লাবের সামনে তর্ক হচ্ছিল। তাঁদের সিপিএম কর্মী স্বামী উত্তম মাজি এবং উৎপল মাজিও সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই পাশের হাজরাপুর থেকে লোকজন জুটিয়ে সেখানে পৌঁছে যান পারুলিয়া অঞ্চলের দুই প্রভাবশলী তৃণমূল নেতা স্বপন মণ্ডল এবং নরুল হোদা। ছিলেন গ্রামের কিছু তৃণমূল নেতাও।

রূপালিদের অভিযোগ, ‘‘ওদের হাতে ছিল লাঠি ও বোমা। অতর্কিতে আক্রমণ করে। বোমা, ঢিল পড়তে থাকে বাড়ির মধ্যে। কোনও রকমে বাড়িতে ঢোকা আটকালেও বাইরে টিনের চালা ভেঙে দিয়ে চারটি গরু খুলে নিয়ে যায়। আমাদের স্বামীরা তখন থেকেই ঘরে ঢোকেননি। পুলিশ এসে শ্বশুরমশাইকে ধরে নিয়ে যায়।’’ একই বক্তব্য কিছু দিন আগে পর্যন্ত কট্টর তৃণমূল সমর্থক বলে পরিচিত বিমান মণ্ডল এবং অরুণ মণ্ডলদের পরিবারের মহিলাদেরও। বিমানবাবুর স্ত্রী অপর্ণাদেবীর অভিযোগ, স্থানীয় দুই নেতার (নুরুল ও স্বপন) অনৈতিক কাজকর্ম মানতে না পেরে স্বামী প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁকে দল থেকে বাদ দেয় নুরুলরা। স্বামী এ বার সিপিএমের হয়ে ভোট করেছেন বলেই তাঁদের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়েছে তৃণমূল। তিনি আরও বলেন, ‘‘স্বামী দেওর কেউ বাড়িতে নেই। আতঙ্ক ভুগছি, আবার যদি ওরা আসে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে পড়তে যেতে পারছে না।’’

ঘটনার আতঙ্কে সারারাত দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে মাঠে রাত কাটাতে হয়েছে এলাকায় সিপিএম কর্মী বলে পরিচিত অসীম মালের স্ত্রী অনিমাদেবীকে। তাঁর কথায়, ‘‘রাতের বেলা ঢিল ছুড়ে, বোমা ফাটিয়ে ওরা যখন বাইরে চিৎকার করছিল। খুব ভয় করছিল। কারা যেন বলে উঠল, ‘মেয়েটাকে বাইরে বের করে উচিত শিক্ষা দে’। সে কথা শুনেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাঁচিল টপকে কোনও রকমে মান ও প্রাণ বাঁচিয়েছি। মাচিপাড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা অনিমা আলো ফুটতে ঘরে ঘরে ঘিরে দেখেন দুষ্কৃতীরা দরজাটাই ভেঙে ফেলেছে।

এ দিকে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল, সেই তৃণমূল নেতা স্বপন মণ্ডল এবং নুরুল হোদা কেউ-ই অভিযোগ মানেননি। তাঁদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা কেন ওখানে যাব!’’ তাঁদের পাল্টা দাবি, ওই গ্রামের এক বাসিন্দা সিপিএম করতেন। এ বার তিনি তৃণমূলে ভোট দেন। তার প্রতিশোধ নিতে সিমিএমের লোকেরাই তাঁর উপরে অত্যাচার করেন। দুই তৃণমূল নেতার অভিযোগ, ‘‘ওই সময় বিষ্ণুপদ ধারা নামে এক দলীয় কর্মী বাধা দিলে তাঁকেও হেনস্থা করা হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রীকেও মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। তিনি এখন সিউড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’’ ওই ঘটনার বদলা নিতেই কি মাজিগ্রামে বাম কর্মীদের ঘরে আক্রমণ? স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘মোটেই তা নয়। ওই এলাকায় আমাদের শক্তি কম। কিন্তু মহিলাকে মারধরের ঘটনায় যাতে না ফাঁসতে হয়, তাই নিজেদের বাড়ির দরজা বা চালের অংশ ছাড়িয়ে আমাদের উপরে দোষ চাপাতে চাইছে সিপিএম।’’ বামেরা যদিও সেই দাবি মানতে চাননি। তাদের দাবি, ওই মহিলা কোনও ভাবে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন। নিজেদের অপরাধ আড়াল করতেই ওই মহিলাকে ঢাল করছে তৃণমূল। কী ঘটেছিল জানতে যোগাযোগ করা হলেও ফোন বন্ধ থাকায় জবাব মেলেনি বিষ্ণুপদবাবুর।

অন্য দিকে, পক্ষপাতের অভিযোগ মানতে নারাজ সদাইপুর থানা। পুলিশের যুক্তি, দু’পক্ষের বিবাদের খবর পেয়ে গ্রামে গিয়ে যাদের এলাকায় পাওয়া গিয়েছে, তাঁদেরই ধরা হয়েছে। এ দিনই ধৃতেরা জামিন পেয়ে গিয়েছেন।

assembly election 2016 CPM supporters cpm attacked TMC Sadaipur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy