জয়োল্লাস। বৃহস্পতিবার, মহানগরে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সবজে রঙের ‘গ্রিন ম্যাঙ্গো’ ফ্লেভার বনাম গোলাপি আভার স্ট্রবেরি রসগোল্লা। আসন্ন উৎসবের ঘুঁটি সাজানো ছিল এ ভাবেই। সাদা-সবুজ শাড়ির পাড়ে ক্ষীর-সন্দেশের মডেলের ‘মমতা-মূর্তি’ পর্যন্ত মজুত ছিল ভোট-গুনতির আগের রাতেই।
কিন্তু অঘটন কিছু ঘটবে না তো? প্রশ্ন উঠতে কলকাতার উপকণ্ঠের নামী মিষ্টি-বিপণির অকুতোভয় কর্ণধার হেসে শুনিয়ে দেন, ‘‘কুছ পরোয়া নেই! সাদা-সবুজ শাড়ির রং পাল্টে জাস্ট একটা বড় টিপ পরিয়ে দেব।’’
বৃহস্পতিবারের কলকাতায় সে সব ঝক্কি পোহাতে হয়নি ছিটেফোঁটাও। বড় টিপ নয়, স্রেফ সবুজ পাড় সাদা শাড়িরই জয়জয়কার। গ্রিন ম্যাঙ্গো রসগোল্লা সাবাড় করে স্ট্রবেরি ফ্লেভারে হাত বা়ড়ান শাসক দলের সমর্থকেরা। ভোট-যুদ্ধের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’।
গণনা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য স্পষ্ট সঙ্কেত মিলেছিল। সেই সঙ্কেতের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চাপ-চাপ সবুজ গুঁড়োয় শহর ছয়লাপ হয়ে গেল। দুপুরে আকাশ কালো হতেই টিপ্পনী, কী রে সূর্য যে একেবারে ঢেকে গেল! বিকেল গড়াতেই আপাদমস্তক সবুজ আবিরে মোড়া অবয়বগুলো স্বস্তির অবগাহনে ভরপুর। হাজরা মোড়ের কাছে পিসি-ভাইঝি বাণী সেন, তনুশ্রী সেনরা অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ৪৫বি রুটের বাস থেকে নেমে পড়লেন। আসছেন সেই বেলেঘাটা থেকে! গন্তব্য, দিদির বাড়ি। হাজরা থেকে পটুয়াপাড়া— ওইটুকু রাস্তা হেঁটেই মেরে দেবেন। ভিজতে ভিজতেই বাণীদেবী বলে গেলেন, ‘‘অনেকে বলেছিল, পরেশদা জিততে পারবেন না। কিন্তু আমরা ঠিক জানতাম...আরে অজিত পাঁজার কাছে ভোটের ট্রেনিং পেয়েছি!’’
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ, সেন্ট টমাস স্কুল বা কসবার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামের মতো গণনা কেন্দ্রগুলোর আশপাশে যেন এক-একটি ‘সবুজ দ্বীপ’। বেলেঘাটায় আলোছায়া সিনেমা হলের সামনে বক্স বাজিয়ে তুমুল নাচাগানা। ববি হাকিমের পাড়া, চেতলায় গোবিন্দ আঢ্যি রোডের মুখটায় এ দিন সকালেই কারা যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৈত্যাকার কাটআউট বসিয়ে দিয়েছিলেন! শহর জুড়ে মোটরবাইকে, ম্যাটাডরে বিক্ষিপ্ত বিজয়-মিছিলের ছড়াছড়ি। বিকেলে গোপালনগরের দিকটায় দেখা গেল, ম্যাটাডরে কাকভিজে জনতা হি-হি কেঁপে নাচতে নাচতে চলেছে।
মমতার সৈনিকদের অনেকেরই এ বার ভোটের ফল নিয়ে খানিকটা হলেও সংশয় তৈরি হয়েছিল। মানিকতলার সাধন পান্ডে বা জোড়াসাঁকোর স্মিতা বক্সী যেমন হাওয়া বুঝে গুটিগুটি গণনা কেন্দ্রে শংসাপত্র নিতে গিয়েছেন। তপসিয়ার আসবাবের দোকানের কর্মী শেখ শাহিদ কিন্তু বললেন, ‘‘আমি জানতাম!’’ শাহিদ তাঁর মোটরবাইকটা সাজিয়েছেন তিন মাস ধরে। ফাইবার, ফোমের ডিজাইনে কাগজের ফুল বসিয়ে সাজসজ্জা। জোড়াফুল ছাপ টি-শার্টে ইংরেজি হরফে বাংলায় লেখা, ‘মা-মাটি-মানুষ চাইল, তাই জাভেদ খান জিতল!’ এই অভিনব পোশাকে গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামের আশপাশে চক্কর কাটছেন।
তবু কসবার এই স্টেডিয়াম-চত্বরই যেন কলকাতার সবুজ মানচিত্রে সামান্য লালের ছোঁয়া। তৃণমূলের প্রমীলা-বাহিনী ছড়া কাটতে কাটতে এগোচ্ছে, ‘এক দো তিন চার / জোট হল পাংচার!’ পাশেই তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে বাম সমর্থকদের জটলা। কলকাতা পুলিশ বা পুর-এলাকায় বাম-কংগ্রেস জোটের দখলে আসা যাদবপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অয়ন পাল, শিক্ষিকা মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রশ্ন, ‘‘বরাবর বলতাম— যাদবপুরে যা হয়, গোটা বাংলায় তা হয়। এ বারের কেসটা কী বলুন তো?’’ কসবার সিপিএম কর্মীদের আক্ষেপ, ‘‘স্রেফ জাভেদের খাস তালুক ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েই আর লিড মেকআপ করা গেল না।’’ কসবার বামপ্রার্থী গোড়ায় তপসিয়ার হাল দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। তিনি আর বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করেননি। সুজনের জয় নিশ্চিত বুঝে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের তরুণ তৃণমূল কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী তাঁকে ‘কাকু কনগ্র্যাটস’ বলে গেলেন।
বামেদের জন্য এটুকুই যা সান্ত্বনা পুরস্কার। নাগরিক পরিভাষায় নতুন শব্দ ‘চড়াম, চড়াম’ মেজাজেই ঢাকের উল্লাস শুরু হয়ে যায় মোটামুটি সাড়ে দশটা-এগারোটা থেকে। ডেভিড হেয়ার কলেজের সামনে পুলিশি ব্যারিকেড এই উচ্ছ্বাসে একটা সময়ে প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। কর্তব্যরত পুলিশ তাঁদের সামলাতে কাকুতি-মিনতির মেজাজে। নাছোড় সমর্থকেরা তখন মোটেও দমবার পাত্র নন। তবু দলেরই এক পান্ডার নির্দেশে তাঁরা নিরস্ত হলেন। ভারী গলার সবুজ পাঞ্জাবি যুবক চোখ টিপে বললেন, ‘‘ভোট শেষ! এখন তো সামনের পাঁচ বছর আমাদেরই পুলিশ। আজ কোনও ঝামেলা করিস না।’’
ঝামেলা নয়। টিভি-তে ভোটের মৌতাত আর ঝমঝম বৃষ্টিতে দিনটা মোটের উপরে ছুটির মেজাজেই কাটাল কলকাতা। সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটের পানশালায় এক ঝাঁক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। বললেন, তৃণমূলের ২০০ হবেই বলে বাজি হয়েছিল। পানভোজনে এখন তারই নিষ্পত্তি হতে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy