কয়েক ঘণ্টাতেই বদলে গেল গ্রামটা।
রাতভর হুমকি, চোখরাঙানির পরেও সকালে ভোট দিতে গিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। রাজত্ব সামলানোর মতোই বুথ সামলেছিলেন প্রবীণ সিপিএম কর্মী। শাসক দলের সব বাধার প্রতিরোধও করেছিলেন তাঁরা। তার মাসুল যে এভাবে দিতে হবে বুঝতে পারেননি তাঁরা।
শিবতলা প্রাথমিক স্কুলের পাশ দিয়ে ঢালাই রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই লোধনা গ্রামের মেটে পাড়া। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রার্থীর সমর্থনে পোস্টার সাঁটাতে গিয়ে দলের কর্মীদের মারধর এবং পুলিশি নিস্ক্রীয়তার অভিযোগে এই মোড়েই লাঠি-ঝাঁটা নিয়ে বিক্ষোভে নেমেছিলেন গ্রামের মহিলারা। পুলিশের গাড়িও ঢুকতে দেননি। শুক্রবার সবটাই বড় খাঁ খাঁ।
টানা হুমকি, ভাঙচুরের জবাবে পাল্টা প্রতিরোধের লোধনা গ্রাম এ দিন স্তব্ধ। ভোটের দিন বুথ সামলে ফিরতেই দুই প্রবীণ কর্মীর খুন হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। মনে প্রশ্ন, একসময় তৃণমূলে গিয়েও যে কারণে ফিরে এসে লড়াই দিচ্ছিলেন, আবারও কী সেখানেই ফিরে যেতে হবে!
বৃহস্পতিবার ভোট শেষে বুথের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সিপিএমের বুথ এজেন্ট মল্লিক পাড়ার শেখ ফজল হক ও মেটেপাড়ার দলীয় কর্মী দুখীরাম ডাল। কিছুটা পিছনে দুখীরামবাবুর ছেলে ও আরও কয়েকজন কর্মী-সমর্থকও ছিলেন। আচমকা জনা তিরিশেক তৃণমূলের দুষ্কৃতী তাঁদের উপর লাঠি, টাঙি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। পিটিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় মল্লিকপাড়ার কালভার্টের কাছে। অভিযোগ, সেখানে হাত-পায়ের শিরা কেটে তাঁদের ফেলে রেখে দুষ্কৃতীরা পালায়। বোমাবাজির চোটে আহতদের কাছে ভিড়তে পারেননি গ্রামের লোকজনও। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। রাতে মারা যান দু’জন।
তবে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশ চাইলে আরও আগে সামাল দিতে পারত গোটা গোলমালটা। বিশেষত খণ্ডঘোষের ওসি বখতিয়ার হোসেনের মদতেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা এই ঘটনা ঘ়টিয়েছে বলে তাঁদের দাবি। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে লোধনার সবিতা সাঁতরা, রবি সাঁতরারা দাবি করেন, ‘‘এক দিকে তৃণমূল বোম মারছে। আর পুলিশ আমাদের আটকে রেখেছে। অথচ তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না।’’
এই কালভার্টেই খুন করা হয়েছিল শেখ ফজল ও দুখীরামবাবুকে (বাঁ দিকে)। তখনও বোমা পড়ে রয়েছে মল্লিকপাড়ায় (ডান দিকে)
ওই ওসির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছেও পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। এমনকী তাঁকে রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে হওয়া সম্ভব নয় বলেও সিপিএমের অভিযোগ ছিল। এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে সিপিএমের রাজ্য কমিটি সদস্য অমল হালদার জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনকে অভিযোগ করেন, “ওই ওসির বিরুদ্ধে আমরা আপনাদের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ওই ওসির জন্যই দুটো মানুষের জীবন চলে গেল।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘ঘটনার সময় জেলা পুলিশ সুপারকে ৫-৬ বার ফোন করেছিলাম। কিন্তু উনি ফোন ধরেনি।’’ দুখীরামবাবুর স্ত্রী মমতাদেবীরও অভিযোগ, “ওই ওসির মদতেই আমার ছেলেকে তৃণমূলের লোকেরা পিটিয়েছিল। এ বার আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করল তৃণমূল।’’ পুলিশ সুপার গৌরব শর্মা জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
তবে পুলিশের সক্রিয় না থাকাই হোক বা তৃণমূলের ‘তাণ্ডব’ গ্রামের আবহ বদলে গিয়েছে। কালভার্টের কাছে জমিতে রক্তের দাগ, মাঠ থেকে উদ্ধার হওয়া সুতলি বোমা, ভাঙা লাঠি ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তাঁদের। সেই সময় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে দুখীরামের ৫টি গরু পুড়েছিল। বাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সমীর মালিক, বলাইচন্দ্র মাঝিদের মতো প্রায় বিশ জনের চাষ বন্ধ করে দেওয়া, নয়তো গভীর নলকূপ থেকে জল নিতে নিষেধের ঘটনা ঘটেছিল। খানিকটা বাধ্য হয়েই তখন তৃণমূলে যোগ দেন শেখ ফজল, সমীরবাবুরা। যদিও জোড়াফুলের ঘরের লোক হতে পারেননি তাঁরা। ফলে কয়েক বছর পর আবারও হুমকি, গোলমাল, কারও ছেলের দোকান খুলতে না দেওয়ার ঘটনায় পুরনো দলে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ফিরে এসে একেবারে বুথে দলের এজেন্ট হয়ে বসেন। গোলমালও বেড়ে যায়। কান্না গিলে ফজল হকের স্ত্রী হেনা বিবি বলেন, ‘‘আমার স্বামী সাহস করে এজেন্ট হবে জানার পর থেকে হাত-পা ভেঙে ফেলে রাখার হুমকি দিয়েছিল। সত্যিই মেরে ফেললে গো! বুথ থেকে আর বাড়ি ফিরতে দিলল না।’’
মেটেপাড়ায় দুখীরামবাবুর দু’কামরার মাটির বাড়িতেও একই হাল। বাড়িতে ছোট ধানের গোলা রয়েছে। ভ্যান রয়েছে। একটি গরুও আছে। বড় ছেলে বিজয় সব্জির ব্যবসা করেন। ছোট ছেলে শিশির বিস্কুট তৈরির কারখানায় কাজ করেন। বিজয় বলেন, “দাদুও সিপিএম করার জন্য খুন হয়েছিলেন। এ বার বাবাও গেলেন।” তাঁর কথায়, “মাস খানেক আগে তৃণমূল আমাদের বাড়ি ভাঙচুর করে। তাতেও সিপিএম ছাড়িনি। বুথ আগলে বসেছিলাম। সেই আক্রোশে বাবাকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়।”
বর্ধমান শহরের পার্কার্স রোডে সিপিএমের দলীয় অফিসে আনা হয়েছিল খণ্ডঘোষে নিহত দুই সিপিএম কর্মীর দেহ। সেখানেই শ্রদ্ধা জানান নেতা-কর্মীরা।
ঘটনাস্থলের খুব কাছেই ছিলেন নিহত শেখ ফজলের ছেলে শেখ সজল হক। বছর চব্বিশের ওই যুবকের কথায়, “ভোট শেষে বাবা ও দুখীরাম কাকা এক সঙ্গেই আসছিলেন। আমরা একটু পিছনে ছিলাম। হঠাৎ বোমাবাজি শুরু হয়। দেখি তৃণমূলের জনা তিরিশ দুষ্কৃতী বাবাকে টানতে টানতে আমাদের বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। মোরাম রাস্তার উপর কালভার্টে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে টাঙি দিয়ে কোপানো হয়। তারপর ওই দুষ্কৃতীরা বোম ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়।” দৃশ্যটা ভুলতে পারছেন না তিনি। ভুলতে পারছেন না মল্লিকপাড়ার তিন কামরার বাড়ির কেউই। যে খেতে মজুরি করে দিন চলে তেমনই জমিতে পড়ে থাকা রক্তের দাগ মুছতে পারছেন না তাঁরা।
ভাইদের রক্তাক্ত দেহ ভুলতে পারছেন না শেখ সিরাজুল। অসহায় ভাবে বাড়ির সামনে বসে তিনি বিড়বিড় করেন, ‘‘২০১১ সালে বাড়িতে হামলা হয়েছিল। এ বার নির্বাচন কমিশনের ভরসায় বুকে বল পেয়েছিলাম। এই তার পরিণাম!’’
ঝাপসা হয়ে যায় লাল মাটি, খড়ের চাল। বৈশাখের গরম হাওয়া ধুলো দিয়ে যায় বৃদ্ধ চোখে।
ছবি: উদিত সিংহ ও নিজস্ব চিত্র।