Advertisement
E-Paper

মাঠে আর সব আছে, বিজেপি নেই

জোট নিয়ে কোনও ঘোঁট নেই। ফরাক্কার ভোটযুদ্ধে তৃতীয় জনের ঠাঁই নেই বললেই চলে। গোটা মুর্শিদাবাদ যখন ত্রিমুখী লড়াই নিয়ে তোলপাড়, শিল্পশহর ফরাক্কায় তখন নয়া রাজনৈতিক সমীকরণ। সরাসরি দুই শিবিরে বিভক্ত— শাসক তৃণমূল আর জোটপ্রার্থী কংগ্রেস।

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১১

জোট নিয়ে কোনও ঘোঁট নেই। ফরাক্কার ভোটযুদ্ধে তৃতীয় জনের ঠাঁই নেই বললেই চলে।

গোটা মুর্শিদাবাদ যখন ত্রিমুখী লড়াই নিয়ে তোলপাড়, শিল্পশহর ফরাক্কায় তখন নয়া রাজনৈতিক সমীকরণ। সরাসরি দুই শিবিরে বিভক্ত— শাসক তৃণমূল আর জোটপ্রার্থী কংগ্রেস। সিপিএম এখানে কংগ্রেসের সঙ্গে। তাই দীর্ঘদিনের বাম ও কংগ্রেসের কুস্তি ফরাক্কায় এখন দোস্তিতে বদলে গিয়েছে। আর এই দোস্তিই শাসক দল তৃণমূলের কাছে রীতিমতো মাথাব্যাথার কারণ।

ফরাক্কা বিধানসভা কেন্দ্রে খাতায়-কলমে প্রার্থীর সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, মূল লড়াই কংগ্রেসের মইনুল হক এবং তৃণমূলের মহম্মদ মোস্তফার মধ্যে। বিজেপির ইন্দ্রনাথ উপাধ্যায়কে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখছেন না দুই প্রার্থীর কেউ।

এ বারের ভোটের অঙ্কের হিসেব বিলক্ষণ জানেন তৃণমূলের মহম্মদ মোস্তফা। কিন্তু প্রকাশ্যে মানেন না। কারণ তা হলে তো ভোটের আগেই লড়াইয়ের মেজাজটাই বিগড়ে যাবে। মইনুল ও মোস্তফা দু’জনেই দাপুটে। তাই ফরাক্কা নিয়ে সন্ত্রাস বা অন্য রকম ভোটের আশঙ্কা করছেন না কেউই। এমনকী বিজেপিও নয়।

ফরাক্কায় ভোটের অঙ্ক বলছে ১৯৭৭ সাল থেকে এই কেন্দ্র কখনও সিপিএম, কখনও কংগ্রেসের দখলে থেকেছে। একটা সময়ে বিজেপির উত্থানও সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে রামশিলা পুজোর মাহাত্ম্যে বিজেপির ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ২৩.৭৭ শতাংশে। বিজেপির সেই বাড়বাড়ন্তে ঘর পুড়েছিল কংগ্রেসের। হেরে গিয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মইনুল হক। ২০১১-তেও বিজেপির বাড়বাড়ন্তে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন তাঁরা। বিজেপির ভোটের শতাংশ নেমে হয় ১৯.৬১। ৩.৫ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে মইনুল সিপিএম প্রার্থীকে হারিয়ে কোনও রকমে জেতেন।

এ বার বিজেপির দাপাদাপি কমলেও বেড়েছে তৃণমূলের থাবা। এলাকায় তেমন ‘দমদার’ প্রার্থী না থাকায় ফরাক্কায় হয়েছে ঠিকাদারিতে জড়িত মহম্মদ মোস্তফাকে তৃণমূল প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এক সময়ে ফরাক্কার বাসিন্দা মোস্তফা প্রায় বিশ বছর ফরাক্কাছাড়া। ফরাক্কায় থাকতে কংগ্রেসের মইনুলের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক লড়াই ছিল দীর্ঘদিনের। তিনি তখন দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন সিপিএমের হয়ে। তার পর সব কিছু ছেড়ে কলকাতার বাসিন্দা।

সেই মোস্তফাকেই কলকাতা থেকে খুঁজে পেতে এনে ফরাক্কায় প্রার্থী করেছে তৃণমূল। প্রথমে তাঁর ঘাসফুল নিয়ে ফরাক্কায় প্রত্যাবর্তনে স্থানীয় তৃণমূল প্রার্থিপদ-প্রত্যাশী নেতারা বিদ্রোহ করার চেষ্টাও কম করেননি। কিন্তু শুরুতেই এনটিপিসি-র ঠিকা শ্রমিক আন্দোলনে একটা বড়সড় সাফল্য ঝুলিতে পুরে ফেলেছেন তিনি। এনটিপিসি-কে রাজি করিয়ে সাসপেন্ড হওয়া ১২ জন নেতাকে কাজে ফিরিয়েছেন। এই সাফল্যই যে একটা তাঁকে ফরাক্কায় নতুন করে পরিচিতি দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে প্রায় হাজার তিনেক শ্রমিককে তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় টেনে আনতে পেরেছেন তিনি, যাঁরা সরাসরি ভোটের ময়দানে মোস্তফার হয়ে প্রচারে নেমেছেন ইতিমধ্যেই।

তবু এখনও দলেরই কেউ কেউ যে তাকে হারাতে তাঁর বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ছেন, সেটাও বিলক্ষণ জানেন মোস্তফা। দলের জেলা নেতারা তাদের বহিষ্কারের কথা বললেও কৌশলী মোস্তফা নিজেই তা আটকে দিয়েছেন। কারণ মোস্তফা জানেন, তাঁর লড়াইটা কার সঙ্গে। তাই এই ষাট বছর বয়সেও চষে বেড়াচ্ছেন ফরাক্কা। সকাল সাড়ে ৮টায় বেরিয়ে রোজ প্রায় চার ঘণ্টা পদযাত্রা, গড়ে সাতটা গ্রামসভা সেরে রাত দেড়টায় ফিরছেন বাড়ি।

মোস্তফা কবুল করেন, “এই শরীরে এত ধকল আর সইছে না। কিন্তু কিছু করারও নেই। গ্রামে গেলে প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন তো? কর্মীরা চাইছেন, তাঁর বাড়িতে একটু যাই, দু’টো কথা বলি, এক কাপ চা খাই। আব্দারও মানতে হচ্ছে। আসলে ফরাক্কায় কখনও তৃণমূলের সংগঠনে সে ভাবে জোর দেওয়া হয়নি। আমাকেই নতুন করে শুরু করতে হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, প্রচারে বেরিয়ে তিনি অভূতপুর্ব সাড়া পাচ্ছেন, যা তিনি ভাবতেও পারেননি। ‘‘বিজেপি এ বারে কোনও ফ্যাক্টরই নয় ফরাক্কায়”— হাসছেন মোস্তফা।

কংগ্রেসের মইনুল হক দীর্ঘ ২০ বছর ফরাক্কার বিধায়ক। ডাকাবুকো নেতা। এলাকায় তাঁর জনসংযোগই যে এই জয়ের সাফল্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এলাকার ডজন খানেক ক্লাবের সভাপতি ও কর্তা তিনি। তাঁর একটা বড় গুণ, কর্মীরা বিপদে পড়লে পাশে থাকা। অপ্রিয় কথাও তিনি মুখের উপরে বলে দিতে পারেন। উন্নয়ন নিয়েও তাঁকে সে ভাবে কাঠগড়ায় তুলতে পারে না বিরোধীরা। শিল্পনগর ফরাক্কা কেন্দ্রীয় জলসম্পদ দফতরের অধীনে। তাই প্রকল্প এলাকার মধ্যে বিধায়কের সে ভাবে উন্নয়ন করার কিছু নেই। তাই তা নিয়ে কোনও হইচইও নেই।

ফরাক্কায় বরাবরই ক‌ংগ্রেসের মূল প্রতি পক্ষ সিপিএম। ২০১১ সালে কংগ্রেস ফরাক্কায় পেয়েছিল ৩৮.৭৭ শতাংশ ভোট, সিপিএম ৩৫ শতাংশ। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৪৯ শতাংশ, সিপিএমের ৪৪ শতাংশ। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে ফরাক্কায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ, সিপিএম ৩১ শতাংশ। এ বারের নির্বাচনে এই জেলায় সর্বপ্রথম কংগ্রেস ও বাম জোটের দাবি উঠেছে ফরাক্কা থেকেই। দুই দলই একাধিক বার বৈঠকে বসেছেন। প্রকাশ্য সভা করে জোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন। দুই দলের নেতাদের কথায় গড়ে তুলেছেন ‘ফেভিকলের জোড়’।

হকের দাবি, “এত ভাল জোট জেলার আর কোথাও হয়নি। আমি চার বার ভোটে জিতলেও সিপিএমের শক্তিও উপেক্ষা করার নয়। তৃণমূলকে হারাতেই এই জোট দরকার। দুই দলের নেতারা তা বুঝেছি বলেই লড়াইটা আরও সহজ হয়েছে।”

আপাতত ফরাক্কায় প্রতিটি গ্রামেই যৌথ সভা হচ্ছে। হাজির থাকছেন মইনুল এবং সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবুল হাসনাত খান। মনোনয়ন দাখিলের অনেক আগে থেকেই ২১৭টি বুথ ঘোরা শেষ তাঁর। মইনুলের দাবি, “দুই দলের সম্মিলিত ভোট সবচেয়ে কম হলে অন্তত ৭০ শতাংশ পাব আমরা। এর মধ্যে কোনও ঘোঁট নেই। বাকি ৩০ শতাংশ পাবেন অন্য প্রার্থীরা।”

সিপিএম নেতা হাসনাত খানও বলছেন, “ফরাক্কায় তৃণমূলকে হারানোই মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই জোট। নিচুতলার কর্মীরাও স্বতস্ফূর্ত ভাবে সামিল এই জোটে। কাজেই ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েই জোট প্রার্থি হিসেবে মইনুলকে জেতানো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

২০১১-য় ফরাক্কায় বিজেপি প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন দলের নেতা হেমন্ত ঘোষ। এলাকায় যথেষ্ট প্রতাপশালী নেতা হিসেবে প্রচারে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দেন কংগ্রেস আর সিপিএমকে। নয়-নয় করে ১৯.৬১ শতাংশ ভোট টেনে চমকেও দিয়েছিলেন। দলে থাকলেও এখন আর তিনি পদে নেই। এ বার তিনি কী বলছেন?

হেমন্তের কথায়, “ভোটে দাঁড়িয়ে বুঝেছি, বুথভিত্তিক সংগঠন ছাড়া ভোটে লড়াই করা যায় না। সে সংগঠন ফরাক্কায় বিজেপির কোথায়? তাই জেতা তো পরের কথা, গত বারের ভোটের ধারে-কাছেও যেতে পারবে না।”

বাকিটা জানেন ভোটারেরা।

BJP Every one Field
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy